18 Dec 2017

দূর্লভ বনছাগল: মন খারাপের গল্প

দূর্লভ বনছাগল: মন খারাপের গল্প

আমাদের একদিনের হরিণের মাংস খাবার বিলাস যেভাবে ধ্বংস করছে আমাদের প্রাণীবৈচিত্র‍্য

মদক পেরোবার পর একটা ঝিরি দেখিয়ে তিনি বললেন এই ঝিরিতে গত পরশু তার ফাঁদে হরিণ পড়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কি হরিণ? সে বললো লাল হরিণ। সাইজ জিজ্ঞেস করলে জানালো বড় ছাগলের সাইজ। মনে মনে ধরে নিলাম সহজলভ্য বার্কিং ডিয়ার বা মায়া হরিণ হবে হয়তো। রাতে পাড়ায় ফেরার পর বৌদি আফসোস করলেন গতকাল আসলে হরিণের মাংস খাওয়াতে পারতেন ইত্যাদি। শেষে চাঙের উপর থেকে ছবির মাথাটা বের করে দিলেন। দেখেই চিনলাম এতোক্ষণ হরিণ সাব্যস্ত করা হলেও এটি ছিলো বনছাগল। পরে শিকারীকে ধরলাম। উনার ভাষ্যমতে উনার চেনা একটা স্পেসিফিক জায়গায় এখনো বেশ ভালো পরিমাণে বনছাগল থাকে। জায়গাটায় বিশাল বিশাল সব পাথুরে গুহা। খাড়া পাথুরে ক্লিফ পাহাড়ের গায়ে। আমি মিলিয়ে নিলাম। এর আগে হাজারীখিল আর কাপ্তাই এর বনে বনছাগল থাকার কথা শুনেছিলাম। হাজারীখিলে হারুয়ালছড়ি খালের ১০কিলোমিটার উজানে "বনমানুষের গুহা" নামে পরিচিত এক পাথুরে জায়গাতেও বনছাগল দর্শনের প্রত্যক্ষদর্শী পেয়েছিলাম। দুই দুই চার মিললো।

বনছাগল বা সেরাও(serow) সন্ধ্যা ও ভোরে খেতে বের হয় আর বাদবাকী সারাদিক চিপায়-চাপায় বসে জাবর কাটে। ঝোপঝাড়ে, পাথুরে ঢালে পালিয়ে পালিয়ে থাকতে পারে বলে এদের দেখা পাওয়া খুব মুশকিল। এদের এক ধরণের গন্ধগ্রন্থি থাকে যার সাহায্যে এরা গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে টেরিটোরি মার্ক করে রাখে।

বনছাগল অত্যন্ত বিপন্ন ও দূর্লভ প্রাণী। অথচ আমরা জেনে-না জেনেই এদের ধ্বংস করে ফেলছি। এরা এত দূর্লভ যে প্রকৃতিতে মুক্ত বনছাগলের ছবি কেউ বাংলাদেশে তুলতে পারেনি বা আমার চোখে পড়েনি। সবখানে বর্ণনা শুনে হাতে আঁকা ইলাস্ট্রেশন ব্যবহৃত হয়েছে। এই দূর্লভ সুন্দর এর দেহাংশের কপালের নরম পশমে হাতটা বুলিয়েই আমাকে তৃপ্ত থাকতে হলো এবারের মত!

যারা পাহাড়ে যান দয়া করে পাহাড়ী দাদারা অফার করলেও হরিণের মাংস খাবেন না। আপনার আগ্রহ তাদের শিকারে উৎসাহ যোগাবে। আপনার রিফিউজ তাকে নিরুৎসাহিত করবে। ভ্রমণে এইটুকু প্রজ্ঞার পরিচয় তো আমরা দিতেই পারি?

( বন্দী অবস্থায় তোলা একটি বন ছাগলের ছবি দিলাম। সাথে একটি সংগ্রহীত উপাখ্যান)
কাপ্তাইয়ে বন ও বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ সফিকুর রহমান ১৯৯৪ সালে আমাকে বলেছিলেন, সেখানকার গহিন অরণ্যে তিনি বনছাগল দেখেছেন। সেবার আমি তাঁর সঙ্গে দুই দিন ঘোরাঘুরি করে চশমাপরা ও রেসাস বানর ছাড়া অন্য কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেখা পাইনি। এরপর অনেক সময় গড়িয়েছে। যতবারই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, বনছাগলের খোঁজ নিয়েছি। যখনই তিনি বনছাগল দেখেছেন বা তথ্য পেয়েছেন, আমাকে জানিয়েছেন। এখন পর্যন্ত তিনি ১২-১৩ বার বনছাগল দেখেছেন। কিছুদিন আগে তাঁর সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল, তখন বলেছিলাম, এবার দেখলে যেন ছবি তোলার চেষ্টা করেন। যা হোক, গত এপ্রিলের মাঝামাঝি তাঁর ফোন পেলাম। তিনি বললেন, চট্টগ্রাম-কাপ্তাই অঞ্চলের গহিন অরণ্যে (সংগত কারণেই জায়গার নাম উল্লেখ করা হলো না) কিছু আদিবাসী দুটি বনছাগলের দেখা পেয়েছিলেন। খবর শুনে তিনিও রওনা হয়ে যান। আদিবাসীরা ভোররাতে পাহাড়ের নিচের দিকে বিচরণরত বনছাগলটিকে তাড়া করেছিল। এতে ছাগলটি খানিকটা আহত হয়েছিল। ততক্ষণে তিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছেন। ফলে ছাগলটি রক্ষা পায়। বিশ্রাম ও কিছু চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার পর সেটি নিজে নিজেই পাহাড়ের চূড়ায় হারিয়ে যায়। তিনি আমাকে ই-মেইলের মাধ্যমে বনছাগলটির ছবি পাঠালেন। সফিকুর রহমানের তোলা ছবিটিই আমার মনে হয় দেশের প্রথম কোনো সত্যিকারের বনছাগলের ছবি। এ দেশ থেকে প্রকাশিত বন্য প্রাণীর কোনো বইয়ে এখনো জীবন্ত বনছাগলের ছবি ছাপতে দেখিনি, সব অঙ্কিত
লিখেছেন: প্রাণীবিজ্ঞানী ডক্টর আমিনুর রহমান

No comments:

Post a Comment