25 Jun 2023

পদ্মা আর মধুমতি সেতুবিহীন সময়ের দক্ষিণ বাংলায় কয়েকটি স্মৃতিময় দিন




 পাঁচ ছয় বছর আগের কথা। লাইরিড মেটিওর শাওয়ার দেখতে ডিসেম্বরের এক হাড় কাপানো সন্ধ্যায় দুই স্কুল বন্ধুসমেত প্যাডেল স্টিমারে চেপে বসেছিলাম। মধ্যমেঘনায় চলমান জলযানের ছাদে শুয়ে রাতের তীব্র শীত উপেক্ষা করে যে কয়েকঘন্টা আমরা তিনজন আকাশপানে চেয়েছিলাম এরই মধ্যে সবমিলিয়ে শ তিনেক ধাবমান উল্কা গুনেছিলাম মনে আছে। মিনিটে দুইটা প্রায়! সে রাতে আকাশটা নেমে এসেছিলো অনেক নিচে অথবা আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম স্বর্গের কাছাকাছি! 




পরদিন হুলারহাট নেমে রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ি ঘুরলাম৷ পরিচয় হলো জমিদারের বংশধর অপূর্ব নারায়ণ রায় চৌধুরীর সাথে। তিনিই সব ঘুরিয়ে দেখালেন। পিরোজপুর শহরে গিয়ে খুঁজে বের করলাম শহীদ বুদ্ধিজীবি ফয়জুর রহমানের (হুমায়ূন আহমেদের বাবা) কবর। তারপর খুলনাগামী বাসের ছাদে চেপে বসলেও  ষাট গম্বুজের সামনে নেমে গেলাম কারণ দুই সফরসঙ্গীর সেটাই প্রথম বাগেরহাট আসা। তারপর খুলনা শহরে ঢু মেরে যশোর গিয়ে বন্ধু সন্তলের বাসায় রাত্রিযাপন। 



পরদিন ট্যুরের শেষদিন। দিনভর ঝিনাইদহের বারোবাজার ঘুরে ক্লান্ত শরীরে সন্ধ্যানাগাদ যশোর শহরে নেমেই খেয়াল করলাম আমার নতুন কেনা সনি আলফা ক্যামেরা সমেত ব্যাগখানা সিএনজিতেই ফেলে এসেছি। যশোর শহর কত বড় সে ধারণা না থাকলেও আরেকটা অটো ডেকে সেই সিএনজির সন্ধান শুরু করলাম। কি ভাগ্য আমার; আধা ঘন্টা পর মিলিয়ে দিলেন মহাজন! সেই সিএনজিচালককে দেখলাম রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করে আমার ব্যাগ ঘাটছেন। বমাল ব্যাগ ফেরত পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাচলাম আর ডিনার সারলাম। দেবুর দোকান থেকে গুড়ের সন্দেশ কিনে যখন বাসস্ট্যান্ডে গেলাম তখন ঘড়ির কাটা সাড়ে দশ ছুঁই ছুঁই। ঢাকার সকল গাড়ি ছেড়ে গেছে। খুলনার যা রাস্তা খুলনা ফেরার সাহস হলোনা। সময়ও নাই। এদিকে আমার কিছু ভাইব্রাদার মাওয়ায় পদ্মার চরে বোয়াল মাছ ধরার প্রোগ্রাম করছে। আমার বিকেল নাগাদই সেখানে যোগ দেয়ার কথা। একটু পর পর তারা খোঁজখবর নিচ্ছে আর বোয়ালের ন্যাজের গপ্পো শুনাচ্ছে! সুতরাং সকাল হলে হোক; আমি সেখানে যাবোই যাবো! কিন্তু আমার দুই বন্ধুর নতুন চাকুরী এবং তারা যেহেতু ফার্মাসিস্ট ও ইঞ্জিনিয়ার তাদের নাকি সকালে অফিস ধরতেই হবে। তাদের তাড়াহুড়োতে রাত সাড়ে এগারোটায় ছাড়ি ছাড়ি করতে থাকা নড়াইলের একখানা ভাঙারি বাসে চড়ে বসলাম। হেলেদুলে নড়াইল পৌঁছে বাসস্ট্যান্ডেই কালনা ফেরীঘাট যাবে এমন কয়েকজনকে পেলাম৷ তাদের সাথে জুটে ফেরীঘাটেও যাওয়া গেলো। নড়াইলের চিত্রা তো নতুন সেতু চড়েই পেরোলাম কিন্তু এবার সামনে যে নদী তার তো কোন সেতু নাই। নদীর নাম মধুমতি। আমরা ছাড়া কোন যাত্রীও নাই। এই মধ্যরাতে পেরোবার গাড়ি নেই তাই ফেরীও বন্ধ। চুক্তিতে খেয়া পেরোলাম৷ খেয়ায় উঠে নৌকার পাটাতনে গা ছড়িয়ে দিতেই দেখলাম অপূর্ব দৃশ্য। দুইদিন আগে উল্কাবৃষ্টি ছিলো। তিনশো উল্কা দেখে এসেছি। দুইদিন পরেও সেই জেরেই বোধকরি আকাশে থেমে থেমে একটা দুইটা উল্কাপতন চলছে।  অথচ আমার হৃদয়ে সেই তিনশো শুটিং স্টারের চেয়ে মধুমতির বুকে দেখা দুই তিনটা ভাংতি উল্কাপতনের স্মৃতি এখনো বেশি জাগরুক। 



কালনা ঘাট পেরিয়ে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কয়েক কিলোমিটার দূরের গোপালগঞ্জের ভাটিয়াপাড়া মোড়। সেখানে গেলে ঢাকা না হলেও নিদেনপক্ষে মাওয়াগামী কিছু পাওয়া যাবে। কিন্তু চারপাশ বিলে ঘেরা সেই নির্জন রাস্তায় এই মধ্যরাতে যাওয়া আর ডাকাতের রামদায় গলা পেতে দেওয়া নাকি এক কথা; এই ভুজুং শুনিয়ে ঘাটের একমাত্র ভ্যানওয়ালা যেতে রাজিনা। অনেক তেল মালিশের পর মহাশয় রাজি হলেন। রাত তিন ঘটিকার দিকে ভ্যানে পা ছড়িয়ে বসলাম। ভ্যানওয়ালা মামা গপ্পো জুড়লো গতমাসে সন্ধ্যারাতে ডাকাতদল কিভাবে তার যাত্রীর গলায় রামদা ঠেকিয়ে সর্বস্ব লুটে নেয়ার পরও ভিকটিমকে বিজি রাখতে রানের মধ্যে একটা টানা পোচ দিয়ে গিয়েছিলো ৷ এই নিশুতি রাতে এমন গপ্পো পাতার কোন মানে হয়?


শেষমেষ ভাটিয়াপাড়া পৌঁছুলাম। ততোক্ষণে খুলনা থেকে আসা সকল বাস চলে গেছে। একটা মাইক্রো ভাঙ্গার মোড় পর্যন্ত যাবে কিন্তু ভাড়া চাচ্ছে জনপ্রতি দেড়শো। যাত্রীও আছে কয়েকজন কিন্তু আমরা সবাই সবাইকে ডাকাত ঠাওরে বসে আছি। অবিশ্বাসের এই খেলাধুলা চললো আরো আধাঘন্টা। এর মধ্যেই চা টা খেয়ে সবার কিছুটা ডর কাটলো আর আমিও মাইক্রোওয়ালাকে জনপ্রতি ২০০ তে ফেরীঘাট পর্যন্ত রাজি করিয়ে ফেললাম! তারপর আর কি! একটানে ঘাটে। ফেরীও পেয়ে গেলাম প্রায় সাথে সাথেই। শেষ রাতের ভয়ংকর শীতে কাঁপতে কাঁপতে ফেরীর ছাদে গেলাম। চারপাশে কুয়াশার চাদরের শ্বেত অন্ধকারে রো রো ফেরীর ইঞ্জিনের গুঞ্জন আর পদ্মার জল কাটার ছলাত ছলাত আওয়াজ ছাড়া কোথাও কেউ নেই। এর মধ্যেই সার্চলাইট জ্বেলে কই যেন যাচ্ছে ফেরী নামের একচোখা সাইক্লপসটা! তাতেও শান্তি নাই; সেই আলোর বীমটাকেও শখানেক মিটার পেরোবার আগেই গিলে খাচ্ছে কুয়াশার রাক্ষস! কই যাচ্ছি কে জানে!


অনন্তকাল পর মাওয়ায় নামলাম। দুই কর্পোরেট জাংকি স্যাঙাতকে ঢাকার বাসে তুলে দিয়ে বসে রইলাম ধলপহরের আলোর অপেক্ষায়! আলোর আভা দেখেই কল লাগালাম ক্যাম্পসাইটে৷ গতরাত থেকে আমাকে বোয়াল মাছের লেজের আশ্বাস দিয়ে দিয়ে এদ্দুর টেনে আনা ফিশমঙ্গাররা জড়ানো গলায় বললো স্পীড বোট ঘাটের পাশে যে চর সেই চরের শেষমাথায় গেলেই দেখা মিলবে ক্যাম্পসাইটের। আমিও সেই উষার অন্ধকারে চরের ভেতর তাদের খুঁজতে লাগলাম। এক পর্যায়ে দেখি আমার চারপাশের বালুচর কুয়াশায় বিলীন৷ এরপর বাঁশি ফুঁকে, চিৎকার করে, লাইভ লোকেশন শেয়ারের মত আরো নানাবিধ নর্তন কুদন শেষে ক্যাম্পসাইটের দেখা মিললো৷ আমি তাবুয় তাবুয় দেবুর সন্দেশ রটিয়ে দিয়ে যখন আমার বোয়াল মাছের ন্যাজখানা চাইলাম তখন মশাইদের পাতিল ঠনঠন! গতকাল থেকে পদ্মার অগাধ জলে কেজিতে কেজিতে পঁচা মৃগেল মাছের পোনা, আরশোলা, ব্যাঙ, কেচো, মহুয়া, মধু, পিপড়ার বাসার টোপ ফেলেও নাকি আমার এংলার ভাইরা একটা বোয়াল মাছের ছাওও পায়নি!





(গত বছর আজকের দিনে পদ্মা সেতু চালু হয়েছিলো। কদিনের ভেতর চালু হয়েছিলো দেশের প্রথম ছয় লেনের মধুমতি সেতুও! গতবছরের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে আমার এই গল্পের অবতারণা!)

18 Apr 2023

ঢাকা শহরের বিখ্যাত অথচ জঘন্য খাবার তালিকা - worst over hyped food place of Dhaka

 

ঢাকা শহরে আমার খাওয়া ওভার হাইপড অথচ অতি জঘন্য কয়েকটা খাবারের বর্ণনা দিলাম। এগুলো কঠিনভাবে বর্জনীয়। আপনার অভিজ্ঞতা ও কমেন্টে এরকম আরো বিখ্যাত ক্রিমিনালদের নাম দিয়ে যাবেন। যাতে পাবলিক এওয়ার হয়: 


১/ বড় বাপের পোলায় খায়: 


মূলত ঢাকার নবাববাড়িতে যে ইফতার মাখা হতো তার উচ্ছিষ্ট দেয়া হতো বাড়ির চাকরবাকরদের। চাকররা সেটা খেয়েই বাইরে আহা উহু গপ দিতো। সেই বর্ণনা শুনে স্থানীয়রাও রাস্তায় সেই ইফতার মাখা বিক্রি শুরু করে এবং নব্বই দশকে মিডিয়ার বদৌলতে মার্কেট পেয়ে যায়। এই খাবার একেবারেই জঘন্য। যেহেতু মাখা আইটেম তাই আগেরদিনের টক হয়ে যাওয়া মুরগী ইত্যাদি মিলিয়ে দেয় চকবাজারের বিক্রেতারা৷ খাইলে অসুস্থ্য হবেন নিশ্চিত৷ 


২/ মুস্তাকিমের চাপ: মুহাম্মদপুর বিহারী ক্যাম্পের এই জিনিসের সুনাম শুনে খেতে গিয়েছিলাম ২০১৫ তে। ভালো লাগেনি। কয়দিন আগেও গেলাম। আরো জঘন্য হয়েছে৷ সকল আইটেমই একই মশলায় মাখে, একই তেলে ভাজা হয়। স্বাদ থাকবে কেমনে? তাছাড়া এই তেল কয়দিনের পুরোনো কে জানে! 


মূলত স্টয়িক ব্লিসের আবার জিগায় গানে মুস্তাকিমের চাপ আবার জিগায় লাইনটার কারবে বেশি হিট খেলেও এখন আর আগের মত জমজমাট নাই কারণ পাবলিক সচেতন হয়েছে। স্পেশালি লুচি নিয়ে এরা যে বাটপারিটা করে সেটা ধরতে পারলে আপনি আর এখানে দুইবার যাবেন না। 


৩/ বেনারসি পল্লীর শওকতের চাপ:  এটা আরেক জঘন্য আইটেম। মুস্তাকিমের মত একই তেলে দুনিয়ার সবকিছু ভাজা হচ্ছে এখানে। আর এত কড়া ভাজা দেয় যে কোনকিছুর মূল স্বাদ বলে কিছু অবশিষ্ট থাকেনা। মূলত একবার পাকিস্তান টিম খেতে গিয়ে জায়গাটা বিখ্যাত করে তুলে কিন্তু আমরা যারা মিরপুর থাকি আমরা ভুলেও ঐ দোকানে খাইনা। 


৪/ কাল্লুর কাবাব: এরা যখন রাস্তার ব্যবসায়ী ছিলো তখন এদের খাবার ও সার্ভিস দুইই ভালো ছিলো। আমরা হাইপ তুলে এদের এত আসমানে তুলেছি যে এখন এরা কাবাবটা পর্যন্ত পুড়ায় না। তেলে ভেজে দেয়। কারণ পুড়ালে টাইম বেশি লাগে। 


৫/ চান্দুর নেহারী: চান্দুর নেহারী এক সময় সস্তা ছিলো এবং হাইপ কম ছিলো বলে ভালো করে জ্বাল দিতেন উনারা। এখন এত চাপ যে এক জ্বালের নেহারী বেচেই কূল পান না। আর এখন পুরোটাই ইম্পোর্টেড নেহারী ইউজ করেন। দামও বাড়িয়ে ফেলেছেন। তাই আর ভালো লাগেনা। তাও যদি খেতে চান বাসায় এসে কয়েকবার জ্বাল দিয়ে খাবেন। 


৬/ বিউটির লাচ্ছি: গত ৫-৭ বছর ধরে লাচ্ছিটা জঘন্য হচ্ছে। গোলাপজলের গন্ধে গেলা দায়। তাই লেবুর শরবতটা খেতাম ঐটাও আর আগের মত নাই। তআছাড়া ঢাকা শহরের সবচে বড় ভাগাড়টা এখন ওদের দোকানের সামনে! আর আমাদের দেশের নাদান ফুড ব্লগারগুলো কিনা বিদেশী ব্লগার আসলে এখানেই নিয়ে যায়!


৭/ হাজী বিরিয়ানী: এইখানে খাসির মাংসের বদলে এখন ছাটের মাংস দেয় কিন্তু দামটা কিন্তু ঠিকই অনেক বেশি নেয়। মাংস আপনি বলতে গেলে পাবেনই না। টাকা দিয়ে হাড় নেয়ার মানে আছে কোন? তাছাড়া পরিমাণ এত কমিয়েছে বলার বাইরে। আগে এক পাতা খেলে পেট ভরতো আর এখন এক পাতায় পেটের অর্ধেকও ভরেনা!  


৮/ কলাবাগানের মামা হালিম: ঢাকার সবচে বাজে হালিম এরা বানায়। কিন্তু দাম নিবে গলাকাটা। কেমনে যে এদের নাম ফাটলো আমি ভেবে পাইনা! 


৯/ শমসের আলীর ভুনা খিচুড়ি: এই দোকানের মার্কেটিং, পলিসি, খাবার সবই বাটপারি৷ সারাক্ষণ এদের হাবভাব আমরা প্রেসিডেন্ট এর খাবার বানাই কিন্তু খাইলে বুঝবেন ফকিন্নীও এদের খাবার গিলবে না! 


১০/ আবেশ হোটেলের মটকা আইটেম: 

এটা পুরাপুরি ফুড ব্লগারদের তৈরী হাইপ। এদের খাবার এত জঘন্য এত জঘন্য যে খাবার পর আপনার মনে হবে মাইক ভাড়া করে এদের গালাগালি করি! 



30 Mar 2021

বান্দরবানের গোপন আতংক অপূর্ব প্রাণী ঢোল, বন কুকুর, রামকুত্তা বা রাংকুর


 ঢোল, বনকুকুর বা রামকুত্তা 


রামকুত্তা সামাজিক প্রাণী। গোত্রের মত বড় বড় দলে এরা বসবাস করে। শিকার ধরার সময় এসব দল আবার ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে যায়।  মধ্যম আকারের তৃণভোজী প্রাণী এদের প্রধান খাদ্য। অত্যন্ত সাহসী রামকুত্তা দলবদ্ধভাবে বন্য শুকর, বুনো মহিষ বা বাঘের মত বড় বড় প্রাণীদেরও আক্রমণ করতে ভয় পায় না। বহু সময় ধরে এরা শিকারকে তাড়া করে আর শিকার একসময় ক্লান্ত হয়ে গেলে দলবদ্ধভাবে ঘিরে ফেলে এবং শিকারের পেট চিরে মৃত্যু নিশ্চিত করে। শিকার করা প্রাণী এদের ছানাদের আগে খেতে দেয়, পরে নিজেরা খায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষকে এড়িয়ে চললেও কিছুক্ষেত্রে মানুষকে আক্রমণ ও হত্যার রেকর্ডও আছে। (তিন্দুতে মাছ ধরতে যাওয়া দলের তাবু আক্রমণ করেছিলো একবার।) 

17 Nov 2020

বিরামপুরের গল্প

 

বিরামপুরের নাম শুনে কল্পনায় নীরব এক রেল স্টেশন, ভরদুপুরে ঘুমের ভারে ঢুলুঢুলু কিছু দোকানীসমেত অল্প কিছু টিনের দোকানপাট আর হলদে ফসলের প্রান্তর ছুঁয়ে যাওয়া শীতের ধুলো উড়া একটা পথ কল্পনা করে নিয়েছিলাম। তিন নাম্বার খানিকটা মিললেও বাকিগুলো মিললোনা। গত কয়েকবছর ধরে আর মিলে না।  নগরায়ণের গ্যাংগ্রিনে শহর তো পঁচে গেছে সেই কবেই! এখন গ্রামগুলোও আক্রান্ত হচ্ছে। বিভূতির উপন্যাস ছাড়া তাই কোথাও আর মিলেনা শতভাগ বিশুদ্ধ গ্রাম।


এখানেও বিষ লেগেছে। সন্ধ্যার পরও সব সরগরম। একশো টাকায় পাওয়া তিনশো টাকার এনার্জি লাইটের আলোয় চারপাশ রোশনাই। বাইছা লন একশো থেকে শুরু করে সান্ডার তেলের ক্যানভাসার সবাই উপস্থিত। সাময়িক দোকানীরা ঝাপ মেলে গ্র‍্যান্ডফাদার ক্লকের কোকিলটার মত উঁকি দিচ্ছে! শুধু কি তাই? ব্যাংকের বুথসমেত ব্রাঞ্চ বসে গেছে বেশ কয়েকটা!


আমি স্থানীয় একটা রেষ্টুরেন্টে ঢুকলাম। যেগুলোকে আমরা 'হোটেল' বলি! যতোটা না নিজে খেতে তারচে বেশি বৃদ্ধ রিকসাচালকটাকে কিছু খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে। নাহ তিনি চা ছাড়া কিছুই খাবেন না। জোরাজুরি করিয়ে শেষতক একটা মিষ্টি! দু-চারটা কথা হলো। বয়স ৬৫। জমি ছিলোনা কখনো তাই গত ৪৫ বছর ধরে রিকসাই চালিয়ে আসছেন। একমাত্র মেয়ের বিয়ে, একটা ভিটি আর ৪৫ হাজার টাকা দামের দুই বছর আগে কেনা এই মোটর রিকসাখানা সবই রিকশা চালিয়ে উপার্জিত টাকায়। আবারো মটর রিকসা জিনিসটাকে মহান এক আবিষ্কার মনে হলো আমার। বগুড়ার শেষ 'মেইল' চলে গেছে তারউপর বিরামপুরে পরিচিত কেউ নাই শুনে উদ্বিগ্ন হলেন। 'ম্যালা টাকা' দিয়ে পুরো ঢাকার টিকেট কেটে নাইটকোচে ঢাকা যেতে হবে বলে আফসোস করতে করতেই তার টিনের বাড়িতে চাইলে থাকতে পারি জানিয়ে দিলেন। আশ্বস্ত করলেন নতুন লেপ আছে। মেয়ের জামাই আসবে বলে নামান নাই এখনো। বেচারার কথা শুনে মায়া হলো। জানালাম চিন্তার কিছু নাই, আমাকে নিতে গাড়ি আসবে। দেড়শো টাকায় তিনঘন্টা চুক্তিতে 'কম হয়ে যায়' বললেও কিন্তু পাছে আমি অন্য রিকসা নিয়ে ফেলি সে ভয়ে দুপুরবেলা নিমরাজি হয়ে গিয়েছিলেন। তাই দুশো টাকা উনার হাতে দিয়ে রাখতে বললেও উনার দ্বিধা কাটেনা! জানতে চান "সবটা?"


এখানে মুসা ভাইয়ের অপেক্ষায় আমাকে ঘন্টাখানেক বসতে হবে তাই ওয়েটারকে বলে ফোনটা চার্জে দিলাম। ব্যস্ত 'হোটেল' তার উপর শহুরে কাষ্টোমার পেয়ে ওয়েটারদের ভালো ব্যবহারে কিছু না খেয়ে শুধু শুধু বসে থাকতে ইতস্তত লাগছিলো। তাই ঢাকায় আমরা যেটাকে মোগলাই বলি (ভেতরে কিমা থাকে) চিটাগাং এ যেটা ডিম-পরোটা (ভেতরে ডিম থাকে) সেই জিনিসখানা অর্ডার করলাম। সার্ভ হলো তেতুলের টক আর সালাদসমেত। কিন্তু ওমা ভেতরে যে আলুভাজি! এও কি হয়! এই অখাদ্য গেলা সম্ভব না। টাক মাথা ফর্সা ওয়েটার লোকটা বোধহয় বুঝলো ব্যাপারখানা। সে এসে আস্তে আস্তে বললো হাসের গোস্ত খাবেন স্যার? চালের রুটিও আছে। প্রথমে নিজের কান বিশ্বাস হলোনা। শেষমেষ ৬ টা রুটি চালান করলাম উদরে। গেটিস দেবার ছলে দুই প্লেট হাসভূনাই দিয়ে দিলো ওয়েটার। সত্যি বহুদিন এত ভালো খাবার খাই নাই। শেষে এক গেলাস দুধ নিয়ে আসলো নিজে থেকেই। জানালাম দুধ খাইনা। সে জানালো এটা ক্যাশ থেকে মালিকে পাঠিয়েছেন। কমপ্লিমেন্টারি! 


আচ্ছা এটা কি আসলেই ২০১৮?

18 Oct 2020

রকষ্টারের বিদায়ের দুই বছর


 বাচ্চু ভাইয়ের সেকেন্ড সলো এলবামের কাভারে লিখা ছিলোঃ 


"তারপর একদিন ভরা জোৎস্নায় আমিও চলে যাব 

একমাত্র নিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে- চির নবান্নের দেশে,

জেনে যাবো; সবকিছুই বড় দেরিতে আসে,

বড় দেরীতে ধরা দেয়; হারিয়ে যায় সেও হঠাৎ করেই! 

শুধু কষ্টটা থেকে যায়! 

আসলে কষ্টটা

এভাবেই ছিল-

কষ্টটা এভাবেই থাকে....!!!"


গায়কী প্রতিভার কথা ভাবলে ছিলেন মিডিওকারেরও নিচে, বিলো এভারেজ। ঘষে-মেজে, সাধনায়, গিটার বাদনে নিজেকে নিয়ে গেছেন লিজেন্ড লেভেলে। সেই স্কুলে পড়ার সময়ই বাবা-মায়ের সেপারেশন। সত্তরের দশকের কথা আমলে নিলে আসলে সেপারেশন ওয়ার্ডটা দিয়ে বিষয়টার ভয়াবহতা বুঝানো যাবেনা। সিম্পলি তখন মানুষ বউ ছেড়ে দিতো যেভাবে তেমনই ছিলো ব্যাপারটা। তিন ভাই নিয়ে এনায়েতবাজারের বাবার বাড়ি থেকে মা সহ বাচ্চুরা চলে আসলেন মাদারবাড়ির নানাবাড়িতে৷ বাবার স্নেহহীন শৈশব-কৈশোরের কষ্টের দিনগুলো বাচ্চু ভাই ভুলেননি কোনদিন, শেষদিকে গাওয়া তাঁর গান "বাবা" শুনলেই তাঁর বাবাহীনতার অভিমানসৃষ্ট কষ্টের তীব্রতা যে তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত  বয়ে বেড়িয়েছেন তা স্পষ্ট বুঝা যায়। তবু বাচ্চু ভাই বাবার সাথে যোগাযোগ রেখেছেন। নিজের কাছে এনে চিকিৎসা করিয়েছেন। সৎ বোন-বোনজামাইদের প্রতি বড়ভাইসূলভ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মা চলে গেলেও তাঁর বাবা এখনো বেঁচে আছেন দুনিয়ায়, বাচ্চু ভাই নেই!  


মুসলিম স্কুল পেরিয়ে সিটি কলেজে, বাচ্চু ভাইয়ের পড়াশোনা আর সামনে গেলোনা গিটারের নেশায়৷ রেয়াজুদ্দিন বাজারে মামার জুতোর দোকানে বসতে হয়, সারাদিন এর পায়ে-ওর পায়ে জুতো গলিয়ে সন্ধ্যায় লালখানবাজারে গিয়ে গুরু জ্যাকব ডায়াসের কাছে থাকা ইলেকট্রিক গিটারটা ছুঁয়ে দেখা৷  যতোটা পারা যায় প্র‍্যাক্টিস করে নেয়া। নিজের যে গিটার নেই!  যখন যে ব্যান্ডে বাচ্চু বাজায় বাকি সবাই বিরক্ত। ছেলেটা সারাদিন প্র‍্যাক্টিস করতে চায়৷ সব গানে পার্টিসিপেট করতে চায়। কিন্তু সোলসের মত মেলো টাইপ ব্যান্ডে লিড গিটারিষ্টের সবসময় পার্টিসিপেশনের সুযোগটা কই? তাই যখন 'মন শুধু মন ছুঁয়েছে' রেকর্ড হয় তখন নিজের অংশগ্রহণ না থাকায় হাত নিশপিশ করতে থাকা বাচ্চু পুরো গানে দুইটা কাঠের টুকরো বাজিয়ে গেলো যা মূল গানের ব্যাকগ্রাইন্ডে এখনো শুনতে পারবেন পুরোটা সময়। এসবই হলো প্রতিভার স্ফুরণ! 


বাচ্চু ভাই নিজে কিছু গাইতে চান, সোলসে রথী-মহারথীদের ভীড়ে চান্স হয়না৷ কি করা যায়? সলো করা যাক! চট্টগ্রাম হকার মার্কেটে জাহেদ ইলেকট্রনিক্সের মূল ব্যবসা শেফালী ঘোষ-শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের আঞ্চলিক গান, মাইজভান্ডারী, মোহসিন আউলিয়া, ওরসের গান বেচা। মরিয়া বাচ্চু তাদের দূর্বল রেকর্ডিংয়েই দুটো এলবাম করে ফেললেন। কোন লাভ হলোনা। আসতে পারলেন না পাদপ্রদীপের আলোয়। অন্যদিকে সোলসের সাউন্ডে যে ডিসটর্শন চান তা পান না। বুঝলেন ঢাকামুখী হতে হবে৷ আলাউদ্দিন আলীদের সাথে কিছু সিনেমার কাজ করে সঙ্গীত পরিচালনা আর সুরের ব্যাপারে অনেক দৃষ্টি প্রসারিত হলো৷ এভাবেই তপন চৌধুরী থেকে জুয়েল অনেকের ডেব্যু হিট এলবামের পিছনের কারিগর হলেন বাচ্চু ভাই৷ কিন্তু সুরকার-সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে ক্যাসেটের কাভারে ব্যবহার করতেন ছদ্মনামঃ রবিন। 


শেষ পর্যন্ত পাততারি গুটিয়ে এলেন ঢাকায়৷ ততোদিনে কিছুটা পরিচয় হয়েছে৷ সোলস ছেড়ে দিয়েছেন। বিয়েও করেছেন বরিশালের মেয়ে। দেশের প্রথম আবাসিক ব্যান্ড এলআরবি শুরু হলো৷ ফুলটাইম আবাসিক আর ফুলটাইম জ্যামিং করা ব্যান্ড। চৌধুরীপাড়ার দুই রুমের বাসার এক রুমে বাচ্চু ভাই থাকতো বউ সহ, আরেক রুমে তাঁরই ছাত্র স্বপন, জয় আর সিইউতে থাকতে ফিলিংসে বাজানো টুটুল। ( তখন জেমস-ফান্টি ব্যান্ড বাদ দিয়ে কানাডায় কামলা দিতে যাওয়ায় টুটুলের এলআরবিতে আসা) জয় বিদেশ গেলো দুই বছরের মাথায়, স্বপন থাকলো শেষদিনতক,  টুটুল তানিয়ার সাথে বিয়ের পর নিজের ক্যারিয়ার গুছাতে চলে যায়। শেষদিন পর্যন্ত বাচ্চু ভাই টুটুলের জায়গায় কাউকে নেননি৷ কিবোর্ড ছাড়াই বাজিয়ে গেছে এলআরবি৷ 


বাচ্চু ভাই চিটাগাং এর ছেলে৷ চিটাগাং এর ছেলেরা বাস্তববাদী,  দায়িত্বশীল আর সংসারী হয়। বাচ্চু ভাইও আজীবন তাই ছিলেন। ব্যবসা এখানে ধর্ম, অস্থিরতা বা পাগলামীর কোন স্থান নেই এখানকার সমাজে। তাই একজন রকষ্টারের অস্থিরতা বুকে ধারণ করে সংসারের সাথে আপস করার কঠিন দ্বন্দযুদ্ধ লড়তে লড়তেই বাচ্চু ভাইয়ের সংগ্রামী জীবন ফুরিয়ে গেছে। না হতে পেরেছেন মুক্ত বিহঙ্গ, না পেয়েছেন পাতানো সংসারে সুখ! বাচ্চু ভাইরা কখনো দায়িত্বের শিকল ছিড়ে মুক্ত আকাশে হারিয়ে যেতে পারেনা৷ মৃত্যুভিন্ন বাচ্চুদের মুক্তি নেই। বাচ্চু ভাই মুক্তি পেয়েছেন।


(আজ বাচ্চু ভাইয়ের মৃত্যুর দুই বছর পূর্তি। 

এই দিনটার জন্যও লোকটা একটা গান গেয়ে গেছেন। লিংকঃ

https://youtu.be/866zsqXqyXs

30 Jul 2020

সকল সেলিব্রেটিদের খানা শেষ, মামুন-অফুর বাংলাদেশ!

সাকিব খান বা সাকিব আল হাসান না। এরাই বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি এক্টিভ ফ্যানওয়ালা সেলিব্রেটি! যাদের নামে থানায় থানায় ফ্যাব ক্লাব আছে!

সাকিব খান বা সাকিব আল হাসান না। এরাই বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি এক্টিভ ফ্যানওয়ালা সেলিব্রেটি! যাদের নামে থানায় থানায় ফ্যাব ক্লাব আছে!

সকল সেলিব্রেটিদের খানা শেষ, মামুন-অফুর বাংলাদেশ।

নোয়াখালীর বার্বার শপে কাজ করা অপু 'অফু বাই' নামে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন লাইকি ও টিকটকে। অফুর উইয়ার্ড হাসি, ক্রিপি হেয়ারস্টাইল ও অদ্ভুত সব ডায়ালগের জন্য এই তরুণকে মূলত রোষ্ট করতে করতে বিখ্যাত বানিয়েছে ইউটিউবাররা। সেকারণেই সে অল্প সময়ের মধ্যেও রিচের দিক দিয়ে মামুনকেও ছাড়িয়ে গেছে। এখন সে ঢাকা এসে তার ফ্যানক্লাবের ফ্যানদের সাথে মিটআপ ও নতুন বান্ধবীদের সাথে ডেট করে বেড়াচ্ছে। তবে এই জগতেও আছে বিরোধ। তারই জের ধরে অফুর ফ্যানদের প্রিন্স মামুনের ফ্যানরা কদিন আগে মারধোর করেছে। এত কিছুর পরেও অফু বাই এর রিচ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।

টিকটক লাইকির সুপারষ্টার বিশ বছর বয়সী প্রিন্স মামুনের ফলোয়ার দশ মিলিয়ন প্লাস বা এক কোটি সামথিং। সে টিকটক ও লাইকি এপে নেচে ও লিপ্সিং করে এত ভক্ত অর্জন করেছে। ঢাকার নানান গলি ঘুপচির মধ্যে নাচানাচি করে পপুলারিটি পেলেও তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তার ফ্যানরা এখন দিয়াবাড়ি, আগারগাঁও, টিএসসি, লালবাগ কেল্লা ও হাতিরঝিলকে পরিণত করেছে টিকটক পাড়ায়। অদ্ভুত ড্রেস আপ ও হেয়ার স্টাইলের শত শত টিন এজার ও তরুণ-তরুণীদের আজকাল মামুনের মত খ্যাতি পাবার আশায় এসব জায়গায় পথচারীদের বিব্রত করে নাচাগানার শুটিং করতে দেখা যায়। পাবলিক ন্যুনসেন্স তৈরী ও ইভটিজিং এর দায়ে গত সপ্তায় মামুনকে দিয়াবাড়িতে স্থানীয় ছেলেরা মারধোরও করেছে। তারপরেও শ্রমজীবি ও কালচারালি ডিপ্রাইভড ইয়ংস্টারদের মধ্যে মামুনের জনপ্রিয়তা কমে নাই। বরং তার নামে এলাকায় এলাকায় ফ্যান ক্লাবের মিট আপ চলছে। ভক্তদের ভালোবাসায় সিক্ত হতে মামুনও তার হলুদ R15 বাইক নিয়ে হাজির হচ্ছেন সেখানে৷ হবেন না কেন? বহু স্কুল ও গার্মেন্টসগামী কিশোর কিশোরীর স্বপ্নের নায়ক যে এখন টেন মিলিয়ন সেলিব্রেটি প্রিন্স মামুন!

যা লিখলাম এসব হলো আমার গত কয়েকদিনের ঘাটাঘাটিতে অর্জিত জ্ঞান। কিন্তু কিভাবে বা কেন এরা এত জনপ্রিয়তা পেলো? এই কোটি কোটি কিশোর কিশোরী কেন এদের মত উইয়ার্ড জিনিসপত্রকে আইডল মেনে নিচ্ছে?? এর কারণ আমার মতে সাংস্কৃতিক বঞ্চনা। বিপুল পরিমাণে শিশু কিশোর শ্রমজীবি আছে বাংলাদেশে যারা কালচারালি আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছে৷ ছয় দিন কাজ করে সপ্তম দিনের ছুটিতে অংশগ্রহণ মূলক একটা বিনোদন মাধ্যম পেয়ে তারা তা আকড়ে ধরেছে৷ কারণ গুরুত্বহীন বঞ্চনার জীবনকে ভুলে এখানেই আছে নায়ক হবার সুযোগ। এদের সাথে যুক্ত হয়েছে অগভীর পারিবারিক মূল্যবোধের স্কুল কলেজে যাওয়া লাখ লাখ শিশু কিশোর যাদের বাবা মা কখনোই তাদের হাতে পড়ার বইয়ের বাইরের কোন বই হাতে তুলে দেয়নি, ঘুরতে নিয়ে যায়নি, খেলতে পাঠায়নি, পাশে বসিয়ে শোনায়নি কোন গল্প বা নীতিকথা।  সর্বোপরি ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, সচেতন বা অসচেতনভাবে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা বা বিনোদনের কোন ব্যবস্থাই করতে পারেনি। এদের অনেকেই খেলার মাঠ না পেলেও নিজের ব্যক্তিত্ব বিকাশের আগেই হাতে পেয়ে গেছে সেলফোন৷ তাই তথাকথিত সহজ জনপ্রিয়তার ট্রেন্ডি আর ফাংকি ব্যাপারগুলোই এদের মনোজগতের মনোযোগ পেয়েছে এবং দিনশেষে সেই ফাঁদেই পড়ে আছে বাচ্চাগুলো!

মানুষের বিনোদন পিপাসী হৃদয় শূণ্যতা চায়না৷ তাই যেখানে পজেটিভ বিনোদন থাকবেনা সেখানে এ ধরণের বিনোদনেই শূণ্যতা পূরণ হবে। দেশ যে একটি সাংস্কৃতিক দূর্ভিক্ষ বা cultural famine এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে টিকটক চর্চা ও টিকটক সেলিব্রেটিদের উত্থান তারই প্রমাণ।

এদের কারো সক্ষমতাকে আমি খাটো করছিনা। যে টিন স্পিরিট, স্বতস্ফুর্ততা আর প্রতিভার ছাপ এদের কর্মযজ্ঞে দেখেছি তা প্রশংসার দাবী রাখে৷ কিন্তু এই প্রতিভার সাথে সুসংস্কৃতি ও সুশিক্ষার চর্চার সুযোগ পেলে এদের প্রতিভা আরো বিকশিত হতো এবং কয়েকদিন পর হুট করে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে পতনের অভিজ্ঞতাটা ওদের হতোনা বলে আফসোসটা থেকেই যাচ্ছে! তারপরেও রইলো শুভকামনা!

অপু নজরুল
২৯-০৭-২০
নোয়াখালীর বার্বার শপে কাজ করা অপু 'অফু বাই' নামে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন লাইকি ও টিকটকে। অফুর উইয়ার্ড হাসি, ক্রিপি হেয়ারস্টাইল ও অদ্ভুত সব ডায়ালগের জন্য এই তরুণকে মূলত রোষ্ট করতে করতে বিখ্যাত বানিয়েছে ইউটিউবাররা। সেকারণেই সে অল্প সময়ের মধ্যেও রিচের দিক দিয়ে মামুনকেও ছাড়িয়ে গেছে। এখন সে ঢাকা এসে তার ফ্যানক্লাবের ফ্যানদের সাথে মিটআপ ও নতুন বান্ধবীদের সাথে ডেট করে বেড়াচ্ছে। তবে এই জগতেও আছে বিরোধ। তারই জের ধরে অফুর ফ্যানদের প্রিন্স মামুনের ফ্যানরা কদিন আগে মারধোর করেছে। এত কিছুর পরেও অফু বাই এর রিচ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।

টিকটক লাইকির সুপারষ্টার বিশ বছর বয়সী প্রিন্স মামুনের ফলোয়ার দশ মিলিয়ন প্লাস বা এক কোটি সামথিং। সে টিকটক ও লাইকি এপে নেচে ও লিপ্সিং করে এত ভক্ত অর্জন করেছে। ঢাকার নানান গলি ঘুপচির মধ্যে নাচানাচি করে পপুলারিটি পেলেও তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তার ফ্যানরা এখন দিয়াবাড়ি, আগারগাঁও, টিএসসি, লালবাগ কেল্লা ও হাতিরঝিলকে পরিণত করেছে টিকটক পাড়ায়। অদ্ভুত ড্রেস আপ ও হেয়ার স্টাইলের শত শত টিন এজার ও তরুণ-তরুণীদের আজকাল মামুনের মত খ্যাতি পাবার আশায় এসব জায়গায় পথচারীদের বিব্রত করে নাচাগানার শুটিং করতে দেখা যায়। পাবলিক ন্যুনসেন্স তৈরী ও ইভটিজিং এর দায়ে গত সপ্তায় মামুনকে দিয়াবাড়িতে স্থানীয় ছেলেরা মারধোরও করেছে। তারপরেও শ্রমজীবি ও কালচারালি ডিপ্রাইভড ইয়ংস্টারদের মধ্যে মামুনের জনপ্রিয়তা কমে নাই। বরং তার নামে এলাকায় এলাকায় ফ্যান ক্লাবের মিট আপ চলছে। ভক্তদের ভালোবাসায় সিক্ত হতে মামুনও তার হলুদ R15 বাইক নিয়ে হাজির হচ্ছেন সেখানে৷ হবেন না কেন? বহু স্কুল ও গার্মেন্টসগামী কিশোর কিশোরীর স্বপ্নের নায়ক যে এখন টেন মিলিয়ন সেলিব্রেটি প্রিন্স মামুন!

যা লিখলাম এসব হলো আমার গত কয়েকদিনের ঘাটাঘাটিতে অর্জিত জ্ঞান। কিন্তু কিভাবে বা কেন এরা এত জনপ্রিয়তা পেলো? এই কোটি কোটি কিশোর কিশোরী কেন এদের মত উইয়ার্ড জিনিসপত্রকে আইডল মেনে নিচ্ছে?? এর কারণ আমার মতে সাংস্কৃতিক বঞ্চনা। বিপুল পরিমাণে শিশু কিশোর শ্রমজীবি আছে বাংলাদেশে যারা কালচারালি আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছে৷ ছয় দিন কাজ করে সপ্তম দিনের ছুটিতে অংশগ্রহণ মূলক একটা বিনোদন মাধ্যম পেয়ে তারা তা আকড়ে ধরেছে৷ কারণ গুরুত্বহীন বঞ্চনার জীবনকে ভুলে এখানেই আছে নায়ক হবার সুযোগ। এদের সাথে যুক্ত হয়েছে অগভীর পারিবারিক মূল্যবোধের স্কুল কলেজে যাওয়া লাখ লাখ শিশু কিশোর যাদের বাবা মা কখনোই তাদের হাতে পড়ার বইয়ের বাইরের কোন বই হাতে তুলে দেয়নি, ঘুরতে নিয়ে যায়নি, খেলতে পাঠায়নি, পাশে বসিয়ে শোনায়নি কোন গল্প বা নীতিকথা।  সর্বোপরি ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, সচেতন বা অসচেতনভাবে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা বা বিনোদনের কোন ব্যবস্থাই করতে পারেনি। এদের অনেকেই খেলার মাঠ না পেলেও নিজের ব্যক্তিত্ব বিকাশের আগেই হাতে পেয়ে গেছে সেলফোন৷ তাই তথাকথিত সহজ জনপ্রিয়তার ট্রেন্ডি আর ফাংকি ব্যাপারগুলোই এদের মনোজগতের মনোযোগ পেয়েছে এবং দিনশেষে সেই ফাঁদেই পড়ে আছে বাচ্চাগুলো!

মানুষের বিনোদন পিপাসী হৃদয় শূণ্যতা চায়না৷ তাই যেখানে পজেটিভ বিনোদন থাকবেনা সেখানে এ ধরণের বিনোদনেই শূণ্যতা পূরণ হবে। দেশ যে একটি সাংস্কৃতিক দূর্ভিক্ষ বা cultural famine এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে টিকটক চর্চা ও টিকটক সেলিব্রেটিদের উত্থান তারই প্রমাণ।

এদের কারো সক্ষমতাকে আমি খাটো করছিনা। যে টিন স্পিরিট, স্বতস্ফুর্ততা আর প্রতিভার ছাপ এদের কর্মযজ্ঞে দেখেছি তা প্রশংসার দাবী রাখে৷ কিন্তু এই প্রতিভার সাথে সুসংস্কৃতি ও সুশিক্ষার চর্চার সুযোগ পেলে এদের প্রতিভা আরো বিকশিত হতো এবং কয়েকদিন পর হুট করে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে পতনের অভিজ্ঞতাটা ওদের হতোনা বলে আফসোসটা থেকেই যাচ্ছে! তারপরেও রইলো শুভকামনা!

অপু নজরুল
২৯-০৭-২০

13 Jul 2020

চুতিয়া সমাচার

চুতিয়া সমাচার

কয়েক বছর আগে আসামের গুয়াহাটি শহরে পদব্রজে ভ্রমণের সময় শহরের ব্যস্ততম ফেন্সীবাজারে রাস্তার ধারে অসমিয়া ভাষায় লেখা এক দেয়াল লিখনে চোখ আটকে যায়। অসমিয়া বর্ণমালা প্রায় বাংলার মতোই তাই পড়া ও বুঝা যায়।  দেয়ালে লিখা ছিলো 'চুতিয়া সন্মিলন' এ যোগদানের আহবান। ব্যাপারটা আজব লেগেছিলো!

সেইসময় ইন্ডিয়ান সিম একটিভ না থাকায় ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম তাই  তাৎক্ষণিকভাবে কিছুই জানা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি নিউজ নজরে পড়ে। নিউজটি আপনাদের জন্য শেয়ার করছি:

"নামের সঙ্গে ‘চুতিয়া’ শব্দটি থাকলেই অ্যাকাউন্ট বাতিল করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে ফেসবুকের বিরুদ্ধে।
শব্দটি উপমহাদেশে গালি হিসাবে ব্যবহৃত হওয়ায় অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে, তবে এ নিয়ে বিপাকে পড়ছেন আসাম রাজ্যের ‘চুতিয়া’ সম্প্রদায়ের লোকজন। ‘দ্যা অল আসাম চুতিয়া স্টুডেন্ট ইউনিয়ন’ বা আসাকসু অভিযোগ করেছে তাদের সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেয়া হয়েছে। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জ্যোতি প্রসাদ চুতিয়া জানান, ফেসবুক আমাদের ‘চুতিয়া’ সম্প্রদায়ের সব সদস্যের অ্যাকাউন্ট বাতিল করে দিয়েছে, নামের শেষে চুতিয়া শব্দটি থাকায় ফেসবুক এটিকে গালি বা মিথ্যা শব্দ মনে করে হয়ত অ্যাকাউন্টগুলো বাতিল করছে। ফেসবুক জানেনা যে ‘চুতিয়া’ হচ্ছে আসামের একটি উপজাতি। অথচ জাতীয় ইতিহাসে আমাদের এ উপজাতির ইতিহাস অনেক গৌরবমণ্ডিত। চুতিয়া সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা এ ঘটনায় কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বলেছে, এ ঘটনাটি আমাদের উপজাতি সম্প্রদায়ের জন্য সম্মানহানির। শিক্ষার্থীরা এ ঘটনায় গুয়াহাটিতে এক মিটিংয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘চুতিয়া’ কমিউনিটির ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।"

চুতিয়ারা বাস করে মধ্য আসাম ও অরুণাচলের কাছাকাছি উত্তর আসামে। ডিব্রুগড়, শোণিতপুর, জোড়হাট, সাদিয়া ও তিনশুকিয়াতে সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ লাখ চুতিয়ার বাস। চুতিয়াদের আছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। দশম থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত প্রায় ৫০০ বছর তারা স্বাধীন চুতিয়া রাজ্যে বসবাস করতো। এ সময় আশেপাশের নানা জনজাতির সাথে নানা যুদ্ধে জয়লাভ করেই তারা তাদের স্বাধীনতা টিকিয়ে রেখেছিলো। তাদের বীরাঙ্গনার নাম সতী সাধনী। বহুদিন ধরেই চুতিয়া জাতি ডিব্রুগড়ে ব্রহ্মপুত্র নদের উপর নির্মানাধীন ভারতের সর্ববৃহৎ দোতলা সেতুর (বগীবিল সেতু) নামকরণ সতী সাধনী সেতু করার দাবী করে আসছে।

এক দেশের গালি আরেক দেশের বুলি। যেমন ভুটানে গেলে মেয়েদের সবচে কমন নাম হলো Choden! যাই হোক এরপরের বার আসাম গেলে একটা না একটা চুতিয়া বন্ধু জুটিয়ে আসতে হবে!