পাঁচ ছয় বছর আগের কথা। লাইরিড মেটিওর শাওয়ার দেখতে ডিসেম্বরের এক হাড় কাপানো সন্ধ্যায় দুই স্কুল বন্ধুসমেত প্যাডেল স্টিমারে চেপে বসেছিলাম। মধ্যমেঘনায় চলমান জলযানের ছাদে শুয়ে রাতের তীব্র শীত উপেক্ষা করে যে কয়েকঘন্টা আমরা তিনজন আকাশপানে চেয়েছিলাম এরই মধ্যে সবমিলিয়ে শ তিনেক ধাবমান উল্কা গুনেছিলাম মনে আছে। মিনিটে দুইটা প্রায়! সে রাতে আকাশটা নেমে এসেছিলো অনেক নিচে অথবা আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম স্বর্গের কাছাকাছি!
পরদিন হুলারহাট নেমে রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ি ঘুরলাম৷ পরিচয় হলো জমিদারের বংশধর অপূর্ব নারায়ণ রায় চৌধুরীর সাথে। তিনিই সব ঘুরিয়ে দেখালেন। পিরোজপুর শহরে গিয়ে খুঁজে বের করলাম শহীদ বুদ্ধিজীবি ফয়জুর রহমানের (হুমায়ূন আহমেদের বাবা) কবর। তারপর খুলনাগামী বাসের ছাদে চেপে বসলেও ষাট গম্বুজের সামনে নেমে গেলাম কারণ দুই সফরসঙ্গীর সেটাই প্রথম বাগেরহাট আসা। তারপর খুলনা শহরে ঢু মেরে যশোর গিয়ে বন্ধু সন্তলের বাসায় রাত্রিযাপন।
পরদিন ট্যুরের শেষদিন। দিনভর ঝিনাইদহের বারোবাজার ঘুরে ক্লান্ত শরীরে সন্ধ্যানাগাদ যশোর শহরে নেমেই খেয়াল করলাম আমার নতুন কেনা সনি আলফা ক্যামেরা সমেত ব্যাগখানা সিএনজিতেই ফেলে এসেছি। যশোর শহর কত বড় সে ধারণা না থাকলেও আরেকটা অটো ডেকে সেই সিএনজির সন্ধান শুরু করলাম। কি ভাগ্য আমার; আধা ঘন্টা পর মিলিয়ে দিলেন মহাজন! সেই সিএনজিচালককে দেখলাম রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করে আমার ব্যাগ ঘাটছেন। বমাল ব্যাগ ফেরত পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাচলাম আর ডিনার সারলাম। দেবুর দোকান থেকে গুড়ের সন্দেশ কিনে যখন বাসস্ট্যান্ডে গেলাম তখন ঘড়ির কাটা সাড়ে দশ ছুঁই ছুঁই। ঢাকার সকল গাড়ি ছেড়ে গেছে। খুলনার যা রাস্তা খুলনা ফেরার সাহস হলোনা। সময়ও নাই। এদিকে আমার কিছু ভাইব্রাদার মাওয়ায় পদ্মার চরে বোয়াল মাছ ধরার প্রোগ্রাম করছে। আমার বিকেল নাগাদই সেখানে যোগ দেয়ার কথা। একটু পর পর তারা খোঁজখবর নিচ্ছে আর বোয়ালের ন্যাজের গপ্পো শুনাচ্ছে! সুতরাং সকাল হলে হোক; আমি সেখানে যাবোই যাবো! কিন্তু আমার দুই বন্ধুর নতুন চাকুরী এবং তারা যেহেতু ফার্মাসিস্ট ও ইঞ্জিনিয়ার তাদের নাকি সকালে অফিস ধরতেই হবে। তাদের তাড়াহুড়োতে রাত সাড়ে এগারোটায় ছাড়ি ছাড়ি করতে থাকা নড়াইলের একখানা ভাঙারি বাসে চড়ে বসলাম। হেলেদুলে নড়াইল পৌঁছে বাসস্ট্যান্ডেই কালনা ফেরীঘাট যাবে এমন কয়েকজনকে পেলাম৷ তাদের সাথে জুটে ফেরীঘাটেও যাওয়া গেলো। নড়াইলের চিত্রা তো নতুন সেতু চড়েই পেরোলাম কিন্তু এবার সামনে যে নদী তার তো কোন সেতু নাই। নদীর নাম মধুমতি। আমরা ছাড়া কোন যাত্রীও নাই। এই মধ্যরাতে পেরোবার গাড়ি নেই তাই ফেরীও বন্ধ। চুক্তিতে খেয়া পেরোলাম৷ খেয়ায় উঠে নৌকার পাটাতনে গা ছড়িয়ে দিতেই দেখলাম অপূর্ব দৃশ্য। দুইদিন আগে উল্কাবৃষ্টি ছিলো। তিনশো উল্কা দেখে এসেছি। দুইদিন পরেও সেই জেরেই বোধকরি আকাশে থেমে থেমে একটা দুইটা উল্কাপতন চলছে। অথচ আমার হৃদয়ে সেই তিনশো শুটিং স্টারের চেয়ে মধুমতির বুকে দেখা দুই তিনটা ভাংতি উল্কাপতনের স্মৃতি এখনো বেশি জাগরুক।
কালনা ঘাট পেরিয়ে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কয়েক কিলোমিটার দূরের গোপালগঞ্জের ভাটিয়াপাড়া মোড়। সেখানে গেলে ঢাকা না হলেও নিদেনপক্ষে মাওয়াগামী কিছু পাওয়া যাবে। কিন্তু চারপাশ বিলে ঘেরা সেই নির্জন রাস্তায় এই মধ্যরাতে যাওয়া আর ডাকাতের রামদায় গলা পেতে দেওয়া নাকি এক কথা; এই ভুজুং শুনিয়ে ঘাটের একমাত্র ভ্যানওয়ালা যেতে রাজিনা। অনেক তেল মালিশের পর মহাশয় রাজি হলেন। রাত তিন ঘটিকার দিকে ভ্যানে পা ছড়িয়ে বসলাম। ভ্যানওয়ালা মামা গপ্পো জুড়লো গতমাসে সন্ধ্যারাতে ডাকাতদল কিভাবে তার যাত্রীর গলায় রামদা ঠেকিয়ে সর্বস্ব লুটে নেয়ার পরও ভিকটিমকে বিজি রাখতে রানের মধ্যে একটা টানা পোচ দিয়ে গিয়েছিলো ৷ এই নিশুতি রাতে এমন গপ্পো পাতার কোন মানে হয়?
শেষমেষ ভাটিয়াপাড়া পৌঁছুলাম। ততোক্ষণে খুলনা থেকে আসা সকল বাস চলে গেছে। একটা মাইক্রো ভাঙ্গার মোড় পর্যন্ত যাবে কিন্তু ভাড়া চাচ্ছে জনপ্রতি দেড়শো। যাত্রীও আছে কয়েকজন কিন্তু আমরা সবাই সবাইকে ডাকাত ঠাওরে বসে আছি। অবিশ্বাসের এই খেলাধুলা চললো আরো আধাঘন্টা। এর মধ্যেই চা টা খেয়ে সবার কিছুটা ডর কাটলো আর আমিও মাইক্রোওয়ালাকে জনপ্রতি ২০০ তে ফেরীঘাট পর্যন্ত রাজি করিয়ে ফেললাম! তারপর আর কি! একটানে ঘাটে। ফেরীও পেয়ে গেলাম প্রায় সাথে সাথেই। শেষ রাতের ভয়ংকর শীতে কাঁপতে কাঁপতে ফেরীর ছাদে গেলাম। চারপাশে কুয়াশার চাদরের শ্বেত অন্ধকারে রো রো ফেরীর ইঞ্জিনের গুঞ্জন আর পদ্মার জল কাটার ছলাত ছলাত আওয়াজ ছাড়া কোথাও কেউ নেই। এর মধ্যেই সার্চলাইট জ্বেলে কই যেন যাচ্ছে ফেরী নামের একচোখা সাইক্লপসটা! তাতেও শান্তি নাই; সেই আলোর বীমটাকেও শখানেক মিটার পেরোবার আগেই গিলে খাচ্ছে কুয়াশার রাক্ষস! কই যাচ্ছি কে জানে!
অনন্তকাল পর মাওয়ায় নামলাম। দুই কর্পোরেট জাংকি স্যাঙাতকে ঢাকার বাসে তুলে দিয়ে বসে রইলাম ধলপহরের আলোর অপেক্ষায়! আলোর আভা দেখেই কল লাগালাম ক্যাম্পসাইটে৷ গতরাত থেকে আমাকে বোয়াল মাছের লেজের আশ্বাস দিয়ে দিয়ে এদ্দুর টেনে আনা ফিশমঙ্গাররা জড়ানো গলায় বললো স্পীড বোট ঘাটের পাশে যে চর সেই চরের শেষমাথায় গেলেই দেখা মিলবে ক্যাম্পসাইটের। আমিও সেই উষার অন্ধকারে চরের ভেতর তাদের খুঁজতে লাগলাম। এক পর্যায়ে দেখি আমার চারপাশের বালুচর কুয়াশায় বিলীন৷ এরপর বাঁশি ফুঁকে, চিৎকার করে, লাইভ লোকেশন শেয়ারের মত আরো নানাবিধ নর্তন কুদন শেষে ক্যাম্পসাইটের দেখা মিললো৷ আমি তাবুয় তাবুয় দেবুর সন্দেশ রটিয়ে দিয়ে যখন আমার বোয়াল মাছের ন্যাজখানা চাইলাম তখন মশাইদের পাতিল ঠনঠন! গতকাল থেকে পদ্মার অগাধ জলে কেজিতে কেজিতে পঁচা মৃগেল মাছের পোনা, আরশোলা, ব্যাঙ, কেচো, মহুয়া, মধু, পিপড়ার বাসার টোপ ফেলেও নাকি আমার এংলার ভাইরা একটা বোয়াল মাছের ছাওও পায়নি!
(গত বছর আজকের দিনে পদ্মা সেতু চালু হয়েছিলো। কদিনের ভেতর চালু হয়েছিলো দেশের প্রথম ছয় লেনের মধুমতি সেতুও! গতবছরের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে আমার এই গল্পের অবতারণা!)