বেড়িয়ে এলাম মাটির নিচে তিন হাজার বছরের পুরোনো আস্ত শহর লুকিয়ে থাকা জনপদে!
(বড় লেখা কিন্তু ইন্টারেষ্টিং, কষ্ট করে পড়বেন)
বহু বছর ধরে আমরা জেনে আসছিলাম আমাদের অঞ্চলের সবচে প্রাচীনতম সভ্যতা মহাস্থানগড়। কিন্তু জ্ঞান কখনো সম্পূর্ণ নয়, অনাবিস্কৃত মাত্র! আধুনিক খনন এবং কার্বন ডেটিং পরীক্ষার মাধ্যমে এখন প্রমাণিত যে আমাদের অঞ্চলের সবচে প্রাচীনতম সভ্যতা উয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নঅঞ্চল। নরসিংদির বেলাবো ও শিবপুর থানার বিভিন্ন গ্রামজুড়ে এই অঞ্চলের বিস্তৃতি, যদিও উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামদ্বয় বেলাবোতেই পড়েছে। উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাপ্ত বর্ণিল কাঁচের পুঁতি ও স্যান্ডউইচ কাঁচের গুটিকা থেকে ও ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের (রোমান সাম্রাজ্য) বহিঃবাণিজ্যের উপর ভিত্তি করে প্রত্নতাত্ত্বিকরা উয়ারী-বটেশ্বরকে বিশ্ববিখ্যাত গ্রিক ভূগোলবিদ টলেমি’র উল্লেখিত "সৌনাগড়া" বলে নিশ্চিত করেছেন।
অনাবিষ্কৃত এই উয়ারী-বটেশ্বরে বড় কোন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রাপ্তির সম্ভাবনা বহুদিন থেকেই । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের দিকে স্থানীয় স্কুলশিক্ষক জনাব মোহাম্মদ হানিফ পাঠান (১৯০১-১৯৮৯) প্রথম উয়ারী-বটেশ্বরকে সুধী সমাজের নজরে আনেন। পরে তাঁর ছেলে জনাব হাবিবুল্লা পাঠান স্থানটির গুরুত্ব তুলে ধরে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বারবারই এব্যাপারে সোচ্চার থাকলেও হচ্ছিলো না উৎখনন। অবশেষে ২০০০ খ্রিস্টাব্দে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে শুরু হয় খনন।
২০০৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-এপ্রিলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎখননে উয়ারী গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে ১৮ মিটার দীর্ঘ, ৬ মিটার প্রশস্ত ও ৩০ সেন্টিমিটার পুরু একটি প্রাচীন পাকা রাস্তা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান এটিকে আড়াই হাজার বছর পুরনো বলে দাবি করেছেন। এসম্পর্কে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার চক্রবর্তীর অভিমতঃ এতো দীর্ঘ ও চওড়া রাস্তা এর আগে পুরো গাঙ্গেয় উপত্যকায় দ্বিতীয় নগরায়ণ সভ্যতায় কোথাও আবিষ্কৃত হয়নি। উপত্যকায় দ্বিতীয় নগরায়ণ বলতে সিন্ধু সভ্যতার পরের নগরায়ণের সময়কে বোঝায়। ফলে যেটি আবিষ্কৃত হয়েছে বলা হচ্ছে তা তধু বাংলাদেশেই নয়, সিন্ধু সভ্যতার পর ভারতবর্ষের সবচেয়ে পুরোন রাস্তা।
নরসিংদীর বেলাব উপজেলায় উয়ারী এবং বটেশ্বর পাশাপাশি দুটো গ্রাম। এই গ্রাম দুটোতে প্রায়ই বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান পাওয়া যেতো। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে উয়ারী গ্রামে শ্রমিকরা মাটি খননকালে একটি পাত্রে সঞ্চিত মুদ্রা ভাণ্ডার পায়। স্থানীয় স্কুলশিক্ষক জনাব মোহাম্মদ হানিফ পাঠান সেখান থেকে ২০-৩০টি মুদ্রা সংগ্রহ করেন। এগুলো ছিলো বঙ্গভারতের প্রাচীনতম রৌপ্যমুদ্রা। এই ছিলো উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহের প্রথম চেষ্টা। তিনি তৎকালীন সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে "প্রাচীন মুদ্রা প্রাপ্তি" শীর্ষক সংবাদ ছাপেন। তিনি তাঁর ছেলে জনাব হাবিবুল্লা পাঠানকে সচেতন করে তুলছিলেন এই এলাকার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সম্পর্কে। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে বটেশ্বর গ্রামে স্থানীয় শ্রমিকরা দুটি লৌহপিণ্ড পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে যায়। ত্রিকোণাকার ও এক মুখ চোখা, ভারী লৌহপিণ্ডগুলো ছেলে হাবিবুল্লাহ তাঁর বাবাকে নিয়ে দেখালে তিনি অভিভূত হোন। ঐ বছরের ৩০ জানুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকার রবি বাসরীয় সংখ্যায় "পূর্ব পাকিস্তানে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা" শিরোনামে একটি প্রবন্ধ ছাপেন জনাব হানিফ পাঠান। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রাপ্তির ঘটনার আমরা উল্লেখ পাই। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে উয়ারী গ্রামের কৃষক জাড়ু মাটি খননকালে ছাপাংকিত রৌপ্য মুদ্রার একটি ভাণ্ডার পান। ওই ভাণ্ডারে কমপক্ষে চার হাজারের মতো মুদ্রা ছিল। ওজন ছিলো নয় সের। জাড়ু মুদ্রাগুলো আশি টাকা সের দরে রৌপ্যকারের কাছে বিক্রি করে দেন। হাবিবুল্লাহ পাঠান তখন নবম শ্রেণীর ছাত্র, তাই মাত্র ৳৭২০ টাকার জন্য ইতিহাসের অমূল্য সামগ্রীগুলো রৌপ্যকারের চুল্লিতে গলে চিরকালের জন্য হারিয়ে গেলো। ১৯৭৪-১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে জনাব হাবিবুল্লাহ পাঠান ঢাকা জাদুঘরের অবৈতনিক সংগ্রাহক ছিলেন। তখন গবেষণার জন্য উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছাপাঙ্কিত মুদ্রা, পাথরের গুটিকা, লৌহ কুঠার ও বল্লম জাদুঘরে অর্পণ করেন তিনি। ঐ সময় রাইঙ্গারটেক গ্রাম থেকে প্রাপ্ত ত্রিশটি লৌহ কুঠার জাদুঘরে প্রদান করেন তিনি। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে উয়ারী গ্রামের শাহবুদ্দিন মাটির নিচ থেকে ব্রোঞ্জের ৩৩টি পাত্রের একটি সঞ্চয় উদ্ধার করেন। বারবার ধরনা দিয়েও সেগুলো সংগ্রহ করতে পারেননি তিনি, অথচ পরবর্তীকালে সেগুলো মাত্র ২০০ টাকায় এক ভাঙ্গারির কাছে বিক্রি করে দেন শাহাবুদ্দিন। জনাব হাবিবুল্লাহ পাঠান একসময় স্থানীয় শিশু-কিশোরদেরকে প্রাচীন প্রত্নসামগ্রী কুড়িয়ে দেয়ার বিনিময়ে সামান্য কিছু পয়সা দিতে লাগলেন আর সংগ্রহ করতে লাগলেন উয়ারী-বটেশ্বর এলাকার অনাবিষ্কৃত অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। তাঁর একাগ্র শ্রমেই খননের আগেই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিলো বঙ্গভারতের দুর্লভ একক নিদর্শন বিষ্ণুপট্ট, ব্রোঞ্জের তৈরি ধাবমান অশ্ব, উচ্চমাত্রায় টিনমিশ্রিত নবযুক্ত পাত্র, শিব নৈবেদ্য পাত্র, রেলিক কাসকিট (ড়েলিচ চাস্কেত)-এর ভগ্নাংশ, পাথরের বাটখারা, নব্যপ্রস্তর যুগের বাটালি, লৌহকুঠার, বল্লম, পাথরের তৈরি সিল, ত্রিরত্ন, কচ্ছপ, হস্তী, সিংহ, হাঁস, পোকা, ফুল, অর্ধচন্দ্র , তারকা, রক্ষাকবচ (আমুলাতে), পোড়ামাটির কিন্নর, সূর্য ও বিভিন্ন জীব-জন্তুর প্রতিকৃতি, রিংস্টোন, ব্রোঞ্জের গরুড়, কয়েক সহস্র স্বল্প মূল্যবান পাথর ও কাচের গুটিকা।
আমি ও আমার মামা এইবার যখন হা্বীবুল্লাহ পাঠানের বাড়িতে গেলাম তখন তিনি ভাতঘুমে, তাই উৎপাত করলাম না। তাঁর ও তার পিতার সব সংগ্রহের কিয়দাংশ নিয়ে একটি সংগ্রহশালা কাম লাইব্রেরী আছে। আমাদের ঘুরিয়ে দেখালেন জনাব হানীফ পাঠানের নাতি আসিফ পাঠান, তিনি ইউল্যাবে এমবিএ করছেন। প্রাচীন প্রত্নতাত্বিক সংগ্রহ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অনেক সংগ্রহ আছে সেখানে, হাবীবুল্লাহ সাহেব নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
আমরা হাবীবুল্লাহ সাহেবদের জ্ঞাতিভাই শাহাবুদ্দীন সাহেবের বাড়িতেও গেছি। তারা রক্ষণশীল মনোভাবের ও সুশিক্ষিত নন বলেই মনে হয়েছে। আমাকে তারা কিছু সংগ্রহ দেখান। তাদের বাড়ির পিছনে একটি প্রত্নতাত্বিক স্থাপনা থাকলেও তাদের অসহযোগিতা ও গোয়া্তুমীর ফলে খনন সম্ভব হচ্ছেনা, একথা আমাদের নিজেই বলেন সে বাড়ির একজন পুত্রবধূ!
এলাকার মানুষজন কমপক্ষে আড়াই হাজার বছর আগের এইসব রঙ্গিন পুঁতিকে "সোলেমানী গুটা" হিসেবে জানতো। বৃষ্টির পর মাটি ধুয়ে গেলে অনেকসময় এগুলো বেরিয়ে পড়তো, এগুলো এলাকাবাসী তসবিহর গোটা হিসেবে ব্যাবহার করতো। এলাকায় ভ্রমনকালে কয়েকজনের কাছ থেকে আমরা সেই কথিত সোলেমানী গুটা কেনার প্রস্তাব পাই। যদিও আমরা আগ্রহ দেখাইনি! কিন্তু তাদের হাবেভাবে যা বুঝলাম অনেকেই কিনে নিয়ে যায়। আসলে কর্তৃপক্ষের উদাসিন্যে অনেক অমূল্য সম্পদ হারিয়ে গেছে ও যাচ্ছে!
জাতীয় যাদুঘরেও আমি একটি আড়াই হাজার বছর আগের কুঠার দেখেছিলাম যেটির প্রাপ্তিস্তাহ্ন হিসেবে ওয়ারী,ঢাকা লেখা ছিলো। আমার তখন বেশ খটকা লেগেছিলো, আসলে এটি উয়ারী হবে আর ১৯৮৪ সালের আগে নরসিংদি ঢাকা জেলাতেই অবস্থিত ছিলো। জাদুঘর কর্তৃপক্ষের এই ভুলটি সংশোধন করা বাঞ্চনীয়।
সুখের বিষয় হলো যে এই এলাকায় জনবসতি তেমন বেশি না। তাই খনন কাজে সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি কারণ তাতে উচ্ছেদের ঝামেলা কম পোহাতে হবে। বর্তমানে খনন বন্ধ রয়েছে, শীতকালে আবার শুরু হবে। তখন আল্লাহ চাহে তো আবার যাওয়ার ইচ্ছা রাখি!
অনেক বড় এই লেখাটি যারা ধৈর্য্য নিয়ে পড়েছেন তারা অবশ্যই এই ব্যাপারে আগ্রহী মননশীল ব্যাক্তি। লেখাটি শেয়ার করবেন যাতে অন্যেরা জানতে পারে।
ছবিতে পাঠান পরিবারের সংগ্রহশালা দেখা যাচ্ছে। ছবিটি মরহুম হানীফ পাঠান সাহেবের।
No comments:
Post a Comment