আলসেমী হচ্ছে সকল সৃষ্টিশীলতার অন্তরায়! এই ট্যুরটা দেয়া হয়েছে অনেকদিন , শুধু আলসেমী করে করে এতোদিন নোটটা নামানো হচ্ছিলো না!আজ প্রতিজ্ঞা করে বসেছি, যে করেই হোক পুরো নোট নামিয়ে তবেই উঠবো! এবারের ট্যুরটি ছিলো আমাদের জন্যে অন্যরকম কারণ পুরো ট্যুরটা আমাদের কাভার করতে হয়েছে প্রচন্ড বৃষ্টিস্নাত পরিবেশে! তবে বৃষ্টির যাদুকরী স্পর্শে প্রকৃতি যেন অনেকদিনের সুপ্তাবস্থা শেষে আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠেছিল! প্ল্যান করা হয়েছিলো দিনচারেক আগে, প্রাথমিকভাবে অনেকেই যাওয়ার আগ্রহ দেখালেও শেষ পর্যন্ত ডাঃ ইমরুল ভাই আগের রাতে জানান যে তিনি আমাদের সাথে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামগামী বাসে উঠতে যাচ্ছেন। তারপর এক বন্ধু যার কিনা পরদিন আমাদের সাথে যাবার কথা জানালো যে আগামীকাল তার ভাই এর আকদ, সে যেতে পারবে না এবং আমাকেও যেতে দিবেনা, অনেক কষ্টে তাকে বুঝিয়ে বললাম যে অলরেডি একজন ভাই ঢাকা থেকে রওনা হয়ে গেছেন, এখন আর কোনভাবেই ট্যুর বাতিল করা সম্ভব না। তারপরও তার সাথে তার ভাবীর বাড়িতে যেতে হলো, সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে রাত আড়াইটা বাজলো! যেকোন ভ্রমণের বা যে কোন গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টের আগের রাতে আমার একদমই ঘুম আসতে চায় না, এবারও তার ব্যাতিক্রম হলোনা। ভোরের আগে আগে চোখ লেগে এসেছিলো, হয়তো ঘুমিয়েছিলামও ঘন্টাখানেক। বন্ধু আরাফাতের ফোনে ঘুম ভাংলো, সে জানতে চাইলো এই প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে যাবো কিনা! আমিও জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলাম মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, যাকে বলে কুকুর-বিড়াল বৃষ্টি! জানালাম আমাদের উপর ভরসা করে একজন ঢাকা থেকে আসছেন, সো পিছিয়ে আসার আর কোন সুযোগ নেই! আরো যারা যাবে তারাও ফোন দিচ্ছিলো, কেউ অপারগতা জানাচ্ছিলো আর কেউবা বলছিলো এই বৃষ্টির মধ্যে কেমনে যাবো! তাদের বুঝ দিচ্ছিলাম যে ভাই ঝর্ণায় ভিজতেই তো যাচ্ছি নাকি? আর আকাশ থেকে তো পানিই পড়ছে, এসিড তো না! প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে বাপের শখের ছাতা কাম ওয়াকিং স্টিকটা নিয়ে বের হয়েছিলাম, ভাবছিলাম সেটি মারাত্নক কাজ দিবে ট্রেকিং এ, দিয়েছিলোও। যাই হোক আগাম ঘোষণা অনুযায়ী পলাশ ভাইদের গ্রুপটা চট্টগ্রাম স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে চেপে বসেছে আর আমরা তখনও নিজ এলাকায় ঘুরপাক খাচ্ছি! সাড়ে সাতটায় পলাশ ভাই এর ফোন দিয়ে জানালো ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। আরাফাত, পাশা আমি আর সিয়াম একটা সিএনজি ঠিক করে পাহাড়তলী স্টেশনে যাবো মনস্থ করলাম কারণ চট্টগ্রাম থেকে পাহাড়তলী আসতে ১০ মিনিটের মত টাইম লাগে ট্রেনের! সিএনজি ছাড়ার পর জাবেদ ভাই এর ফোন, প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে তিনি উপস্থিত, আরেকটু দেরী হলো। আমরা যখন পাহাড়তলী স্টেশনে নামলাম তখন ট্রেন ছাড়ি ছাড়ি করছে, জানালা দিয়ে পলাশ ভাই ডাকাডাকি করছিলো, এর মধ্যেই এট দ্যা ইলেভেন্থ আওয়ার কাকভেজা হয়ে ট্রেনে উঠতে পারলাম! বাইরে তখনও তুমুল বৃষ্টি! দেড় ঘন্ট্রা জার্নির পর বারৈয়ারহাটের চিনকি আস্তানা স্টেশনে নামলাম, ওইদিকে ঢাকা থেকে ইমরুল ভাইও মীরসরাই পৌছে অপেক্ষা করছেন আমাদের জন্যে! বাসে চেপে পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা পৌছে গেলাম মীরসরাই মূল বাজারে! এবার পূর্বদিকগামী মীরসরাই কলেজ রোডে আমাদের যাত্রা শুরু, কলেজগেটের সামনে অপেক্ষমান থাকে লোকাল সিএনজি, তার দুইটাতে চেপে বসলাম আমরা, জনপ্রতি ১০টাকা ভাড়া দিয়ে প্রায় দেড়-দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা নামলাম ব্র্যাক পোল্ট্রি ফিড কমপ্লেক্সের সামনে, সেখানে নেমে ছড়া ধরে উত্তরদিকে হাঁটা শুরু, পায়ে চলা পথ ধরে কখনো পুব কখনো বা উত্তরদিকে হেটে চলতে লাগলাম!
এর মধ্যেই আমাদের দু’পাশে কাশবনে ছাওয়া খরস্রোতা ছড়া দুইবার অতিক্রম করতে হয়েছে। শরৎ আসে আমাদের নাগরিক জীবনেও, সুনীল আকাশে চলতে থাকে পেজা তুলোর মত সাদা মেঘের ভাসাভাসি কিন্তু ব্যাস্ত নাগরিকের ব্যাস্ততা এড়িয়ে আকাশপানে তাকাবার অবসর কোথায়? তাই শহুরে শরৎ নিভৃতে এসে নিভৃতেই চলে যায়, সেখানে কাশবন দেখার সুযোগ কোথায়? সুতরাং সাদা কাশবনের আড়ালে গর্জন করে বয়ে চলা খরস্রোতা ছড়ার দর্শন পাওয়াই কম কি আমাদের মত শহুরে বালকের কাছে, তাতেই হলেম ধন্য সবাই! এসব রঙ্গে রূপে ভরা পথ মাড়িয়ে এক সময় পৌছে গেলাম বোয়াইল্যা ঝর্ণার কাছাকাছি।স্থানীয় কৃষক মনোবল ভেঙ্গে দিলো , বললো আজ় তো অনেক পানি , যেতে পারবেন না , গেলেও কুম সাঁতরে যেতে হবে! যাই হোক খরস্রোতা ছড়ায় নেমে লুকিয়ে থাকা পাথর এড়িয়ে ছোট্ট একটা ঝর্ণা পেলাম, তাই বা কম কি! তাতেই পোলাপান মেলা খুশী!
সেখানে একদফা গা ভিজিয়ে একটু সামনে যেতেই শোনা গেল সেই দৈত্যের গর্জন! এক সংকীর্ণ খাড়ির ওপাশে দেখা যাচ্ছে প্রমত্তা বোয়াইল্যা! আর সেই সংকীর্ণ খাড়িতে সে কি স্রোত! আমি আর পলাশ ভাই একটু সাহস করে ভুল পথে উপরে উঠে ঝর্ণার শীর্ষদেশ দেখে এলাম, প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে সব পিচ্ছিল হয়ে আছে! নেমে আসলাম নিচে! এবার সিদ্ধান্ত হলো সাঁতরে বা লাইফ জ্যাকেট গায়ে চাপিয়েই চলে যাবো। একে একে দেয়াল ধরে ধরে স্রোত এড়িয়ে পৌছে গেলাম ঝর্ণার তলদেশে!
সেকি প্রচন্ড শক্তিশালী ধারা, সে জলস্রোত ঘাড় পেতে ঘাড়ে নেয়া যায়না, মনে হয় স্রোতের তোড় ধড় থেকে নামিয়ে নেবে মাথা! স্রোতের প্রচন্ড আওয়াজে কান পাতা দায়, আশেপাশের ঝোপঝাড়ে এমন বাতাসের নাচন যেন ঝড় বইছে! এর মধ্যেই আমরা তীব্র বৃষ্টিতে উন্মাদ হয়ে উঠা বোয়াইল্যা প্রপাতের সগর্জনে বয়ে চলা জলের তোড়ের ঠিক নিচে খুজে পাই এক টুকরো আশ্রয়! প্রকৃতি মা কাউকে নিরাশ করেন না! দুইটি আলাদা ধারা মিলে এই বোয়াইল্যা ঝর্ণা, সাধারণত এতো পানি থাকেনা সেখানে কিন্তু প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে এই ভিন্ন রূপ দেখার সৌভাগ্য হলো আমাদের!
পরবর্তীতে অবশ্য আমরা হাতের বাম পাশ দিয়ে একটি সহজ পথ খুজে পেয়েছিলাম ঝর্ণার তলদেশে যাওয়ার! সে যাই হোক আমাদের তখনো অনেক কিছু দেখা বাকি, বোয়াইল্যা দেখা শেষে পায়ে চলা পথে ধরে উত্তরমুখী চলে আবার ফিরে আসতে হলো মূল ছড়ায়, তারপর আবার ছড়া ধরে ট্রেকিং শুরু। স্রোতের বিপরীতে হাটতে কষ্ট হচ্ছিলো তার উপর হাঁটু পানি কোথাও কোথাও কোমড় ছাড়িয়ে বুক পর্যন্ত উঠে যাচ্ছিলো! এভাবে অনেকটা ট্রেক করার পর হাতের ডানপাশে একটি ঝোপে ঢাকা পড়া ঝিরি চোখে পড়লো, সেই ঝিরি ধরে খানিকটা গেলে চোখে পড়লো বাউশ্যা ঝর্ণা, লোকালরা বলে বাউশ্যা ছড়া। সেই ঝর্ণার ঢাল অনেক সংকীর্ণ হলেও আমাদের কাছে অপেক্ষাকৃত কম খাড়া মনে হওয়াতে অত্যুৎসাহী আমরা কয়েকজন সেই সুরঙ্গসম ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে থাকি!সেদিন বাউশ্যা ঝর্ণার উপরের ৩০ ডিগ্রী এঙ্গেলের খাড়া পিচ্ছিল সুরঙ্গসম খরস্রোতা ছড়া ধরে উঠতে উঠতে বন-পাহাড়ের অনেক বেশী গভীরে চলে গিয়েছিলাম আমরা, অতটুকু গভীরে- যতটুকু গেলে বাঁশ কাটতে পাহাড়ে আসা আদিবাসী ত্রিপুরা যুবক পর্যন্ত বলে, "আর সামনে যাইসনা, গাছভালুক ধরিবে!" যাই হোক ভেঙ্গেই বলি, আমরা চারজন যাচ্ছিলাম হঠাৎ দেখতে পাই সামনে চকচকে ধারালো দা হাতে কি যেন করছে দুই আদিবাসী যুবক, এম্নিতেও সুরঙ্গের ভুতুরে পরিবেশ তার উপর একটু আগে সাপের সদ্য ছাড়ানো ছাল দেখে আসা আমাদের মধ্যে দুইজন ঘাবড়ে গিয়ে ফিরতি পথ ধরেন, আমরা কথা বলি সেই দুই যুবকের সাথে, তারা কাটা বাঁশগুলো একসাথে বেধে ভেলা বানাচ্ছিলো, একটু পর নাকি ভাসিয়ে দিতো ঢাল বরাবর! এই কথা শুনে আমাদের রক্ত পানি হয়ে এলো, টাইমিং এর একটু এদিক-সেদিক হলে একসাথে শখানেক বাঁশের মধ্যে গেথে যেতাম আমরা সেদিন! সে যাই হোক তাদের কাছ থেকে জানলাম সারাদিনে শখানেক চিকন বাঁশ কেটে শতিনেক টাকা পায় তারা, এই কঠিন জীবন আর ভালো লাগে না একটি কম বেতনের সহজ চাকুরী চায় তারা! যাই হোক তাদের নাম পরিচয় জেনে যোগাযোগের ফোন নাম্বার নিয়ে আরেকটু সামনে এগিয়ে ব্যাক করলাম আমরা!
এবার আবার মূল ছড়ায় ব্যাক করে উত্তর দিকে ট্রেকিং শুরু! আমাদের মধ্যে অনেকেই এর মধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে স্রোতের বিপক্ষে যুদ্ধ করতে করতে কিন্তু সব ক্লান্তি হাওয়া হয়ে যায় যখনই পথের বাঁকে বাঁকে উঁকি দিয়ে উঠে সবুজ পাহাড়ের সারি! আরও কিছুক্ষণ পর উত্তরমুখী ছড়া বাক নিলো পুবে! সেখানে দেখা পেলাম এক অপূর্ব পাথুরে ঢালের! এ ঢালের সৌন্দর্য কি-বোর্ডে প্রকাশ সম্ভব না তাই বেশি কিছু লেখছি না, শুধু বলবো এই ঢালের উপর থেকে নেমে আসা পানি তিন-চার ধারায় বিভক্ত হয়ে যেভাবে সমতলে গড়িয়ে পড়ে তার সৌন্দর্য যে কোন ঝর্ণার চেয়ে কোন অংশে কম না! স্থানীয় লোকেরা এই ঢালকে বলে উঠান ঢাল!
উঠান ঢালে আমরা ঘরে উঠানের মতোই নিশ্চিন্তে অনেকক্ষণ বসি, ইতিমধ্যেই আমাদের মধ্যে কয়েকজন ফিরতে তাড়া দিচ্ছিলো! কিন্তু তারপরও বাকি ৪ জনকে ঢালে ফটোসেশানের জন্যে রেখে আমরা আরো উপরে উঠতে থাকি!
এক পর্যায়ে আমরা দেখতে পাই যে ঝোপঝাড়ে ঢাকা একটি ঝিরি , এই ঝিরিতে প্রবেশ করেই বুঝতে পারি যে অনেকদিক এদিকটায় কেউ আসেনি। লতা পাতা আর কাটাঝোপে সম্পূর্ণ ঠাসা সেই ঝিরিতে অনেক জায়গায় উপর থেকে নেমে আসা ঝোপঝাড়ের দঙ্গল লাঠি দিয়ে সরিয়ে পথ করে নিয়ে সামনে এগোতে হচ্ছিলো! চোখে পড়লো দারুন কিছু ক্যাসকেড! এভাবে ১০-১২ ফুটি দুই-তিনটি চমৎকার ক্যাসকেড পাড়ি দিয়ে আমরা এসে পৌছলাম পাহাড়তলী অমরমানিক্য ঝর্ণার তলদেশে!
এর মধ্যেই আমাদের দু’পাশে কাশবনে ছাওয়া খরস্রোতা ছড়া দুইবার অতিক্রম করতে হয়েছে। শরৎ আসে আমাদের নাগরিক জীবনেও, সুনীল আকাশে চলতে থাকে পেজা তুলোর মত সাদা মেঘের ভাসাভাসি কিন্তু ব্যাস্ত নাগরিকের ব্যাস্ততা এড়িয়ে আকাশপানে তাকাবার অবসর কোথায়? তাই শহুরে শরৎ নিভৃতে এসে নিভৃতেই চলে যায়, সেখানে কাশবন দেখার সুযোগ কোথায়? সুতরাং সাদা কাশবনের আড়ালে গর্জন করে বয়ে চলা খরস্রোতা ছড়ার দর্শন পাওয়াই কম কি আমাদের মত শহুরে বালকের কাছে, তাতেই হলেম ধন্য সবাই! এসব রঙ্গে রূপে ভরা পথ মাড়িয়ে এক সময় পৌছে গেলাম বোয়াইল্যা ঝর্ণার কাছাকাছি।স্থানীয় কৃষক মনোবল ভেঙ্গে দিলো , বললো আজ় তো অনেক পানি , যেতে পারবেন না , গেলেও কুম সাঁতরে যেতে হবে! যাই হোক খরস্রোতা ছড়ায় নেমে লুকিয়ে থাকা পাথর এড়িয়ে ছোট্ট একটা ঝর্ণা পেলাম, তাই বা কম কি! তাতেই পোলাপান মেলা খুশী!
সেখানে একদফা গা ভিজিয়ে একটু সামনে যেতেই শোনা গেল সেই দৈত্যের গর্জন! এক সংকীর্ণ খাড়ির ওপাশে দেখা যাচ্ছে প্রমত্তা বোয়াইল্যা! আর সেই সংকীর্ণ খাড়িতে সে কি স্রোত! আমি আর পলাশ ভাই একটু সাহস করে ভুল পথে উপরে উঠে ঝর্ণার শীর্ষদেশ দেখে এলাম, প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে সব পিচ্ছিল হয়ে আছে! নেমে আসলাম নিচে! এবার সিদ্ধান্ত হলো সাঁতরে বা লাইফ জ্যাকেট গায়ে চাপিয়েই চলে যাবো। একে একে দেয়াল ধরে ধরে স্রোত এড়িয়ে পৌছে গেলাম ঝর্ণার তলদেশে!
সেকি প্রচন্ড শক্তিশালী ধারা, সে জলস্রোত ঘাড় পেতে ঘাড়ে নেয়া যায়না, মনে হয় স্রোতের তোড় ধড় থেকে নামিয়ে নেবে মাথা! স্রোতের প্রচন্ড আওয়াজে কান পাতা দায়, আশেপাশের ঝোপঝাড়ে এমন বাতাসের নাচন যেন ঝড় বইছে! এর মধ্যেই আমরা তীব্র বৃষ্টিতে উন্মাদ হয়ে উঠা বোয়াইল্যা প্রপাতের সগর্জনে বয়ে চলা জলের তোড়ের ঠিক নিচে খুজে পাই এক টুকরো আশ্রয়! প্রকৃতি মা কাউকে নিরাশ করেন না! দুইটি আলাদা ধারা মিলে এই বোয়াইল্যা ঝর্ণা, সাধারণত এতো পানি থাকেনা সেখানে কিন্তু প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে এই ভিন্ন রূপ দেখার সৌভাগ্য হলো আমাদের!
পরবর্তীতে অবশ্য আমরা হাতের বাম পাশ দিয়ে একটি সহজ পথ খুজে পেয়েছিলাম ঝর্ণার তলদেশে যাওয়ার! সে যাই হোক আমাদের তখনো অনেক কিছু দেখা বাকি, বোয়াইল্যা দেখা শেষে পায়ে চলা পথে ধরে উত্তরমুখী চলে আবার ফিরে আসতে হলো মূল ছড়ায়, তারপর আবার ছড়া ধরে ট্রেকিং শুরু। স্রোতের বিপরীতে হাটতে কষ্ট হচ্ছিলো তার উপর হাঁটু পানি কোথাও কোথাও কোমড় ছাড়িয়ে বুক পর্যন্ত উঠে যাচ্ছিলো! এভাবে অনেকটা ট্রেক করার পর হাতের ডানপাশে একটি ঝোপে ঢাকা পড়া ঝিরি চোখে পড়লো, সেই ঝিরি ধরে খানিকটা গেলে চোখে পড়লো বাউশ্যা ঝর্ণা, লোকালরা বলে বাউশ্যা ছড়া। সেই ঝর্ণার ঢাল অনেক সংকীর্ণ হলেও আমাদের কাছে অপেক্ষাকৃত কম খাড়া মনে হওয়াতে অত্যুৎসাহী আমরা কয়েকজন সেই সুরঙ্গসম ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে থাকি!সেদিন বাউশ্যা ঝর্ণার উপরের ৩০ ডিগ্রী এঙ্গেলের খাড়া পিচ্ছিল সুরঙ্গসম খরস্রোতা ছড়া ধরে উঠতে উঠতে বন-পাহাড়ের অনেক বেশী গভীরে চলে গিয়েছিলাম আমরা, অতটুকু গভীরে- যতটুকু গেলে বাঁশ কাটতে পাহাড়ে আসা আদিবাসী ত্রিপুরা যুবক পর্যন্ত বলে, "আর সামনে যাইসনা, গাছভালুক ধরিবে!" যাই হোক ভেঙ্গেই বলি, আমরা চারজন যাচ্ছিলাম হঠাৎ দেখতে পাই সামনে চকচকে ধারালো দা হাতে কি যেন করছে দুই আদিবাসী যুবক, এম্নিতেও সুরঙ্গের ভুতুরে পরিবেশ তার উপর একটু আগে সাপের সদ্য ছাড়ানো ছাল দেখে আসা আমাদের মধ্যে দুইজন ঘাবড়ে গিয়ে ফিরতি পথ ধরেন, আমরা কথা বলি সেই দুই যুবকের সাথে, তারা কাটা বাঁশগুলো একসাথে বেধে ভেলা বানাচ্ছিলো, একটু পর নাকি ভাসিয়ে দিতো ঢাল বরাবর! এই কথা শুনে আমাদের রক্ত পানি হয়ে এলো, টাইমিং এর একটু এদিক-সেদিক হলে একসাথে শখানেক বাঁশের মধ্যে গেথে যেতাম আমরা সেদিন! সে যাই হোক তাদের কাছ থেকে জানলাম সারাদিনে শখানেক চিকন বাঁশ কেটে শতিনেক টাকা পায় তারা, এই কঠিন জীবন আর ভালো লাগে না একটি কম বেতনের সহজ চাকুরী চায় তারা! যাই হোক তাদের নাম পরিচয় জেনে যোগাযোগের ফোন নাম্বার নিয়ে আরেকটু সামনে এগিয়ে ব্যাক করলাম আমরা!
উঠান ঢালে আমরা ঘরে উঠানের মতোই নিশ্চিন্তে অনেকক্ষণ বসি, ইতিমধ্যেই আমাদের মধ্যে কয়েকজন ফিরতে তাড়া দিচ্ছিলো! কিন্তু তারপরও বাকি ৪ জনকে ঢালে ফটোসেশানের জন্যে রেখে আমরা আরো উপরে উঠতে থাকি!
এক পর্যায়ে আমরা দেখতে পাই যে ঝোপঝাড়ে ঢাকা একটি ঝিরি , এই ঝিরিতে প্রবেশ করেই বুঝতে পারি যে অনেকদিক এদিকটায় কেউ আসেনি। লতা পাতা আর কাটাঝোপে সম্পূর্ণ ঠাসা সেই ঝিরিতে অনেক জায়গায় উপর থেকে নেমে আসা ঝোপঝাড়ের দঙ্গল লাঠি দিয়ে সরিয়ে পথ করে নিয়ে সামনে এগোতে হচ্ছিলো! চোখে পড়লো দারুন কিছু ক্যাসকেড! এভাবে ১০-১২ ফুটি দুই-তিনটি চমৎকার ক্যাসকেড পাড়ি দিয়ে আমরা এসে পৌছলাম পাহাড়তলী অমরমানিক্য ঝর্ণার তলদেশে!
এই ঝর্ণাকে যেন প্রকৃতি ঢেকে রাখতে চাইছে নিজের শ্যামল আচ্ছাদনে! ঝর্নাটি একটি মঞ্চের উপর উপবিষ্ট! প্রথমে উঠতে হয় এই মঞ্চে তারপর ঝর্ণাদর্শন।
এখানে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফিরতি পথ ধরে ফিরে আসলাম যেখানে এই ঝিরির শুরু! সামনেই ছিলো আরেকটি ঝর্ণা, নাম ন হাইত্যে কুম! কিন্তু আমার সঙ্গীদের ভেতর দুই একজনের আর যাবোনা মনোভাবের কারণে আমাকেও রণে ভঙ্গ দিতে হলো সেদিনের মত! আসলে আমরা আসছিলাম স্রোতের বিপরীতে হাটুপানি ভেঙ্গে তাই মনে হয়েছিলো অনেকটা পথ কিন্তু ফিরতি পথে সময় লাগলো অনেক কম। যাই হোক এই একটা আফসোস থেকে গেলো। হয়তো এই আফসোসই পরবর্তীতে আবার সেখানে যাওয়ার প্রেরণা যোগাবে! মীরসরাই এর মূল বাজার অত্যন্ত অনুন্নত, সে তুলনায় মীরসরাই থানার অন্তর্গত বারৈয়ারহাট বাজার অনেক উন্নত! মীরসরাই মূল বাজারে একটা ভালো ভাতের হোটেল পর্যন্ত নেই। সেখানকার এক হোটেলে আমার প্রথমে উল্লেখিত সেই শখের ছাতাটি ভুলে ফেলে আসি! ফিরতি পথে এক জায়গায় আমার পা এতো গভীর কাদায় ডুবে যায় যে অনেক কষ্টে টেনেটুনে পা তুলতেও জুতো থেকে যায় ভেতরেই। আরেক পাটি তাই মনের দুঃখে ফেলে দিয়ে খালি পায়েই ব্যাক করি। আমি তো তাও জুতো আর ছাতা হারিয়েছি আমাদের বন্ধু সিয়ামের ক্যামেরা আর সেলফোন দুইটাই নষ্ট হয়ে যায় পানি ঢুকে! স্থাবর অনেক জিনিসপত্র হারিয়ে এলেও অস্থাবর যে স্মৃতি নিয়ে এসেছি তার তুলনায় আর সব নস্যি!
**স্পেশাল ধন্যবাদ দিবো বড়ভাইসম ডাঃ ইমরুল হাসান ওয়ার্সি ভাইকে। তিনি ঢাকা থেকে না এলে আমাদের সেদিনকার ট্যুরটা নিশ্চিত বাতিল হতো!
**স্পেশাল ধন্যবাদ দিবো বড়ভাইসম ডাঃ ইমরুল হাসান ওয়ার্সি ভাইকে। তিনি ঢাকা থেকে না এলে আমাদের সেদিনকার ট্যুরটা নিশ্চিত বাতিল হতো!
ছবিগুলো ২০১৩ সালের বর্ষার।
No comments:
Post a Comment