26 Feb 2017

ভাষার মাসে বাংলার পথে: ইতিহাসের সাক্ষী ভীমের পান্টি দর্শন

হাজার বছর আগে কেমন ছিলো আমাদের বাংলা ভাষা? 

হাজার বছর আগে লেখা চর্যাপদের একটি বাংলা কবিতায় এক দুঃখী কবি তার সংসারের অভাবের ছবি  এঁকেছেন। 

"টালতে মোর ঘর নাহি পড়বেষী।
হাড়ীতে ভাত নাহি নিতি আবেশী।
বেঙ্গ সংসার বডহিল জাঅ।
দুহিল দুধ কি বেন্টে ষামায়।"

কবি বলেছেন, টিলার উপরে তাঁর ঘর, সেখানে কোনো প্রতিবেশী নাই। হাঁড়িতে ভাত নাই, প্রতিদিন উপোস করেন। ব্যাঙ এর মতো সংসার বাড়ছে, দুধ দোয়ানো হয়েছে, কিন্তু লাভ নাই। দোয়ানো দুধ আবার যেন ফিরে যাচ্ছে গাভীর বাঁটে।

বুঝা গেলো তখনকার জনবিরল বাংলার তূলনামূলক নিরাপদ স্থান টিলার উপর ঘর বাঁধা কবির জীবনে একাকীত্বও ছিলো দু:খের অন্যতম উৎস। অভাবী কবির লেখা বলছে তখনও ভাতই ছিলো বাঙ্গালীর প্রধান খাদ্য কিন্তু তাও কবির নিয়মিত জুটতোনা। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর প্রচলন ছিলোনা তার উপর চিত্তবিনোদনের অভাব, কবি তাই সারাবছর খালি পেটে টিলার উপরে বসে বসে কবিতা লিখেন আর বছর বছর ব্যাঙ এর মত সংসারের সাইজ বাড়ান। লাষ্ট লাইনটা আমার কাছে মেটাফোর বা রূপক মনে হয়েছে। এমন আলসে লোকের গরু-গাভী থাকার কথা না। থাকলেও বাঘের পেটে যাবার কথা! 

এই যখন অবস্থা এরই মধ্যে ধরুন আপনি হঠাৎ টাইম মেশিনে চেপে চলে গেলেন হাজার বছর আগের বাংলায়। আপনি লোকটা এবং মাথাটা কিন্তু ২০১৭ সালের। ঢাকা শহরে না, হাজার বছর আগে ঢাকা শহর এখন যেখানটায় সেখানটায় জলাভূমিতে পূর্ণ অসংখ্য এঁদো ডোবা ভিন্ন কিছু ছিলোনা। তাই হয়তো গেলেন প্লাইস্টোসিন যুগে গড়া রাঢ়, হরিকেল, পুন্ড্র, ত্রিপুরা বা বরেন্দ্রের কোথাও। রাস্তাঘাটে হাটছেন, দূরে দূরে শন-বাঁশ আর খড়ের ঘরবাড়ি। চারপাশে কদাচিৎ দু-চারটা লেংটি পড়া লোকজন চোখে পড়ছে। (লুঙ্গি আমাদের আদি পোষাক নয়, আমাদের আদি পোষাক গামছা আর লেংটি) সবার মাথায় সবার তেল চুপচুপে বাবড়ি চুল বা টিকিভাসা চকচকে টাক। শাড়ি কাপড় প্যাচানো ভদ্রমহিলা থেকে শুরু করে সে যুগের মাতারী কারোরই কাঁচুলী বা ব্লাউজ নাই। থাকবে কেমনে? এসবের আমদানী হলো এই সেদিন। আধুনিক পোষাক পড়া আপনি নিজের দিকে তাকান একবার, কত বেমানান আপনি! এইবার গেলেন কথা বলতে, দুই লাইনও বুঝবেন না। ভাষা কিন্তু বাংলাই! লিখে বুঝাবেন? কই লিখবেন? কিসে লিখবেন? এত সহজ না! কলম-কালি-কাগজ সে যুগে এত "সস্তা" না! ধরলাম মাটিতে কাঠি দিয়াই আঁকলেন! কেউ বুঝবেনা। লেখার ধাচ হাজার বছরে পালটে গেছে খোলনলচে! ইন দ্যা মিনটাইম কাঁচারীর থ্রুতে রাজদরবারে খবর চলে গেছে অদ্ভুত এক চিড়িয়ার আগমণের। কোটাল এলো পাইক-পেয়াদা-বরকন্দাজসমেত। এরপর আপনি বিদেশী স্পাই কোটায় শুলে চড়বেন না হাতির পায়ের তলে যাবেন নাকি দরবারের মন জয় করে সভাসদ হয়ে সাতমহলা প্রাসাদে হেরেম খুলে বসবেন তার কল্পনার ভার নাহয় আপনার উপরই ছেড়ে দিলাম! 

ছবি: গত সপ্তায় ঘুরে আসা ভীমের পান্টির গায়ে এগারোশ বছর আগে লেখা বাণীসমূহ। বাংলার আদিরূপ ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা। ভীমের পান্টি কি জানতে আপনাকে যেতে হবে আরো আগে! চলুন জানি ভীমের পান্টির ব্যাপারে:


বাংলার হারানো অতীত: বারোশ বছরের ভীমের পান্টি

মঙ্গলবাড়ি বাজার পৌঁছুতে পৌঁছুতে বেলা মরে এলো। আর দশ কিলো এগুলেই জয়পুরহাট জেলা সদর। মাথায় তখনও নানা আকাশ-কুসুম প্ল্যান ঘুরছে। ভোরবেলায় পোলাও কোর্মা সাটিয়ে আসলেও সারাদিন পেটে দানাপানি পড়েনি। পড়বে কিভাবে! খেয়ে নষ্ট করার মত এক দন্ড সময়ও যে হাতে নেই! তাড়াতাড়ি গুগল ম্যাপ আর স্থানীয় অটো চালকের সহয়তায় রওয়ানা হলাম ভীমের পান্টির উদ্দেশ্যে। ৫টাকা নিলো অটোওয়ালা, বিরাট নবাব সে, কাঁচা রাস্তায় নামবে না। অগত্যা কয়েক ছটাক পথ হেটেই চলে এলাম ভীমের পান্টির সামনে। বিরাট হতাশ হলাম, যেমন ছবি দেখেছিলাম তত বিশাল না এই স্তম্ভ। কালো কষ্টিপাথরে ( Black Basalt) নির্মিত অর্ধভগ্ন স্তম্ভটি (বর্তমান উচ্চতা ১৬ ফুট ৯ ইঞ্চি, গোড়ার দিকের পরিধি প্রায় ৬ ফুট।) ছবিতে দেখে আরো বিশাল মনে হয়েছিলো। তাছাড়া বজ্রপাতে সেই কবেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ভীমের পান্টির মাথায় থাকা গরুড় পাখি! গরুড় বা গারুদা বিষ্ণুর বাহন, অধুনা ইন্দোনেশিয়ান এয়ারলাইনসের লোগো! আকারে হতাশ হলেও চমৎকৃত হলাম স্তম্ভের দেয়ালে ২৮ লাইনের স্পষ্ট ব্রাক্ষ্মীলিপিতে উৎকীর্ণ বাণী দেখে! কিছু কুলাঙ্গার এখানেও ধারালো কিছু দিয়ে আচড়ে লিখেছে নিজের নাম! তবু এই ২৮টা লাইনের উপর হাত বুলিয়ে আমি যেন ফিরে গেলাম বারোশ বছর আগের এমন কোন একদিনের এমন কোন এক সন্ধ্যায়! 

গল্পটা বলবো মহাভারত থেকে। তবে সবার জ্ঞাতার্থে জানাই‚ স্থানীয় শব্দ পান্টি হল রাখালের গরু চরাবার লাঠি। পঞ্চপাণ্ডব যখন মা কুন্তিকে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন‚ ওই সময় ভীমের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় হিড়িম্বা রাক্ষসীর। হিড়িম্বার ইচ্ছা পূর্ণ করতে ভীম তাকে বিবাহ করেন। শর্ত ছিল‚ হিড়িম্বার একটি পুত্রসন্তান না হওয়া পর্যন্ত ভীম তার সঙ্গে থাকবেন। হিড়িম্বা এরপর ভীমকে নিয়ে আকাশপথে এই স্থানে এসে পৌঁছান। এখানে মানুষ তখন চাষবাস জানত না। তাই দেখে ভীম পতিত জমি উদ্ধার করে একাই চাষবাস শুরু করেন। কিছুদিন পরে হিড়িম্বার গর্ভে ঘটোৎকচের জন্ম হল। ভীমও ফিরে গেলেন ভাইদের কাছে। তবে যাবার আগে তাঁর গরু চরাবার লাঠি তথা পান্টি মাঠের মাঝে গুঁজে রেখে গেলেন। সেই লাঠি পরে পাথরে পরিণত হলেও আজও তেমনই পোঁতা রয়েছে। 

গেলো পৌরাণিক বিশ্বাসের কথা। এইবার আসি ইতিহাসে: 

প্রায় বারোশ বছর আগে পালরাজ নারায়ণপালের রাজত্বকালে (৮৭৩–৯২৭ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর ব্রাহ্মণ মন্ত্রী ভট্ট গুরবমিশ্র নিজ বাসস্থানের কাছে ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশে এই গরুড়স্তম্ভটি স্থাপনা করেছিলেন। সাধারণত এই জাতীয় স্তম্ভ যিনিই প্রতিষ্ঠা করুন‚ শিলালিপিতে দেশের রাজা‚ সম্রাট অথবা দেবতার প্রশস্তিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠাতার নাম উল্লেখ থাকে মাত্র। কিন্তু এই স্তম্ভের সুদীর্ঘ শিলালিপিতে মূলত রয়েছে মন্ত্রী ভট্ট গুরবমিশ্রের বংশ গরিমার কথা। পাল রাজাদের কথা এসেছে প্রসঙ্গক্রমে। যেমন ১৫ নং শ্লোকে বলা হয়েছে‚ ভট্ট গুরবমিশ্রের পিতা কেদারমিশ্রের যজ্ঞ অনুষ্ঠানে পালরাজ শূরপাল স্বয়ং উপস্থিত হয়ে নতশিরে পবিত্র মঙ্গলবারি (খুব খিয়াল কইরা! গ্রামের নাম মঙ্গলবাড়ি কিন্তু এখান থেকেই এসেছে) গ্রহণ করে ধন্য হয়েছিলেন। গর্বভরে গুরবমিশ্র জানাচ্ছেন‚ সম্রাট দেবপাল স্বয়ং পরামর্শ গ্রহণের জন্য তাঁর প্রপিতামহ প্রধান মন্ত্রী দর্ভপাণির গৃহদ্বারে প্রতীক্ষায় থাকতেন।  বরেন্দ্রীতে তাই নারায়ণপালের কর্তৃত্ব প্রায় ছিল না বললেই চলে। ভট্ট গুরবমিশ্র পদমর্যাদায় মন্ত্রী হলেও প্রায় স্বাধীন রাজার মতোই বরেন্দ্রী শাসন করতেন। বাদাল স্তম্ভের প্রশস্তিলিপিতে তিনি তাই নিজ বংশ গরিমার কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে স্বয়ং পাল রাজাদের মহিমা খাটো করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। মোটকথা এই স্তম্ভ রীতিমত সূর্য থেকে বালি গরম টাইপ ফাপর স্তম্ভ! তবে ইতিহাসের অমূল্য উপাদান ছাড়াও এটি অবশ্যই সে সময়কার বাংলাদেশের মানুষের বীরত্ব, আত্মমর্যাদাবোধ ও স্বাধীনচেতা মানসিকতার পরিচায়ক!

মঙ্গলবাড়ি, ধামইরহাট, নওগাঁ

কিভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে জয়পুরহাট বাসে বা ট্রেনে, জয়পুরহাট শহর থেকে জয়পুর-দামুইরহাট সড়ক ধরে ১০কিলো গেলেই মঙ্গলবাড়ি বাজার। সেখান থেকে হাটে বা অটোতে ভীমের পান্টি

No comments:

Post a Comment