3 Jul 2020

ছবিটি আমার প্রিয় একটি এপিটাফের। ছোটবেলা থেকেই চট্টগ্রামের কাট্টলী অঞ্চলের এই কবরের পাশ দিয়ে নিয়মিত চলাফেরা করেছি, অনেক সময় দিনে একাধিকবারও। উনার সম্পর্কে কিছুই জানতাম না তখন, শুধুমাত্র উনার এপিটাফ পড়ে উনাতে মুগ্ধ হয়েছিলাম। জীবিতাবস্থায় এতো চমৎকার একটি হৃদয় ছোয়া এপিটাফ যিনি রচনা করেছেন তার সম্বন্ধে নিঃসন্দেহে ধারণা করা যায় যে তিনি একজন জ্ঞানী, মহান, উদার ও আধুনিক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যাক্তি ছিলেন। তাঁর জীবনের কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অধ্যায় সবার সাথে শেয়ার করছি। 

মরহুম মুফতি মাওলানা তমিজুর রাহমান ছিলেন উপমহাদেশের বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, ইতিহাসবিদ, বাংলা, উর্দু, ফার্সি ও আরবিতে সমান দক্ষতা থাকায় তাঁকে বহুভাষাবিদও বলা যেতে পারে। তিনি বহু কিতাব রচনা করেন যেগুলো কালের গর্ভে সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে। তিনি মহাকবি ইকবালের শিকওয়া ও জবাবে শিকওয়া কাব্যগ্রন্থদ্বয়ের বাংলা অনুবাদ করেন। তাছাড়া ইকবালের আরেক মহান কাব্য "আশরারে খুদি ও রামুজে বেখুদি" বাংলায় অনুবাদ করে তিনি বিদ্যান মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। প্রকাশিত কিতাব ছাড়াও তাঁর আরো অনেক অনুবাদের পান্ডুলিপি তাঁর মৃত্যুর পর যথাযত সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যায়।

ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তিনি একজন আধুনিক দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যাক্তি ছিলেন। একজন মুফতি হিসেবে বহু বিতর্কিত বিষয়ে গ্রহনযোগ্য ফতোয়া বা সমাধান দিয়ে তিনি তৎকালীন আলেম সমাজে সুনাম অর্জন করেছিলেন। 

কাট্টলী নূরুল হক স্কুল স্থাপনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। তাছাড়া আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদের বেদখল হয়ে যাওয়া বহু জমি মামলা লড়ে এবং বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ পূণরুদ্ধারের  মাধ্যমে উদ্ধার করে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি।

বৃটিশ আমলে কবি নজরুলের সাথে তাঁর পত্র যোগাযোগ ছিলো৷ কবি চট্টগ্রাম আসলে তিনি তাঁকে কাট্টলী গ্রামে আমন্ত্রণ জানান এবং বিশাল সংবর্ধনা দেন। নজরুলের আগমণ উপলক্ষ্যে তিনি একটি বিশাল কবিতা রচনা করেন যা নজরুল সংবর্ধনায় তিনি পাঠ করেন। কবিতাটির একাংশ নিন্মে উল্লেখ করা হল,

" আজ আমাদের গুলশানেতে
ফুল ফুটেছে শীতকালে,
অগ্নিবীণার বুলবুলিটি
গাইঁবে গজল ডালে ডালে!
...........................

আয়রে দোয়েল, আয় পাপিয়া
ভক্তি গুলের হার গাঁথিয়া,
আগমনীর নজরানা দে
বিশ্বকবি নজরুল গলে!
গরীব দেশে আর কি আছে
তৌফা দিতে চরণতলে?"

তাঁর জন্ম যে বাড়িতে সে বাড়ি আজো তমিজ বাড়ি নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে সে বাড়িতে জহুর আহমেদ চৌধুরীর মতো  মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী মহান নেতার জন্ম হয়।  তিনি বাংলাদেশের প্রথম শ্রমমন্ত্রী ছিলেন এবং তাঁর নামে জহুর হকার্স মার্কেট ও বিভাগীয় স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়।  তারপরও তমিজ সাহেবের নামেই আজো সেই বাড়িটি পরিচিত। অথচ আজকাল এই মহান ব্যাক্তির জীবন ইতিহাস সম্পর্কে  তেমন কোন সচেতনতা পরিলক্ষিত হচ্ছেনা।

১৮৭৮ সালে জন্ম নেয়া মহান এই ব্যাক্তি ১৯৫০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বেই তিনি তাঁর এপিটাফটি লিখে যান, এবং তাঁর অছিয়ত অনুসারে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কবরে এপিটাফটি স্থাপিত হয়!

এপিটাফটি নিন্মরূপঃ

"এ পথে গমণকালে ওহে বন্ধুগণ
নিরাশ্রয় তমিজেরে করিও স্মরণ
দাঁড়াইয়া সমাধির পাশে দয়া করে
দোয়া করিবেন মম মুক্তির তরে!"

**লেখাটি ২০১২ সালে লিখেছিলাম, আজ খুঁজতে গিয়ে দেখলাম লেখাটি এই আইডি থেকে পোষ্ট দেয়া হয়নি৷ তাই দিয়ে রাখলাম। তথ্যের জন্যে রফিক আহমেদ চৌধুরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

No comments:

Post a Comment