17 Jun 2017

পাহাড়ঘেরা শৈশব



এটা গল্প হলেও পারতো, পাতা একটা-আধটা পড়তাম...

বাসার পিছনে পাহাড় আর পাহাড়। বিকেলে ঘুড়ি উড়াতে উঁচু পাহাড়টায় উঠলে মনে হতো পাহাড়ের ঢেউ ভাঙছে। সেই পাহাড়গুলোই একসময় কাটা শুরু হলো। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের বড় বড় বুলডোজার পাহাড় কেটে সমান করছে সারাদিন, দেখার মত দৃশ্যই বটে! কিছুদিন পর পাহাড়ের পাদদেশে আমরা পেলাম অসংখ্য খেলার মাঠ। নানা নাম দেয়া হলো মাঠগুলোর; লর্ডস, টরেন্টো, ইলেভেন স্টার, ধূমকেতু, ফ্রেন্ডশিপ আরো কত কি! এখন আর আগের মত মাঠ আর দখল করা লাগেনা, এলাকার বড় ব্যাচ-ছোট ব্যাচ সবারই এখন আলাদা মাঠ। তখন আমরা আট টাকার নিপ্পন টেপ বলে পেচিয়ে সকাল বিকাল দুই টাকার ম্যাচ খেলি। তবে পাহাড় আর ঝিল (ফয়স লেক) এর প্রতি আলাদা একটা আকর্ষণ থেকেই যায়। এরই ভেতর আরো ভেতরের পাহাড়ে যাওয়ার সুযোগ হলো পাখিশিকারী রাজু (পরবর্তীতে শীর্ষ সন্ত্রাসী, ডাবল মার্ডার কেসে জেলে) আর মুসলিমের (পেডরোলোর ইঞ্জিনিয়ার) সঙ্গী হয়ে। এরা দক্ষ শিকারী, আর আমার সবে গুলতিতে হাতেখড়ি। এদের সাথেই ফয়স লেক, বারোমাসিয়া, জামতলা, হারবাতলী, নুরনবী শার মাজার, জালালাবাদ পাহাড় ঘুরি পাখির খোঁজে। আমার মত দূর্বল নিশানার শিকারীকে সাথে রাখার সুবিধা হচ্ছে দিনশেষে আমি শিকারের ভাগ চাইনা। চেয়ে লাভ কি, বাসায় তো নিয়ে যেতে পারবোনা। শিকার নিয়ে বাসায় গেলে একটা মারও মাটিতে পড়বেনা তাই নিজ হাতে খরগোস ধরেও দিয়ে দিতে হয় অন্যকে। পাহাড়ের ঘুঘু শিকারী, বনরুই শিকারী, ছনকাটা লোকদের দেখে মুগ্ধ হই। ছনকাটারা সকালে আঁটি বাঁধার একটা মোটা লাঠি আর দা নিয়ে এরা পাহাড়ে ঢুকে। সন্ধ্যা নাগাদ মাথাভর্তি ছন নিয়ে লোকালয়ে ফিরে। ছনের ভারে স্বাভাবিকভাবে হাটতে পারেন না তাই কেমন যেন লাফিয়ে লাফিয়ে ম্যারাথন স্টাইলে দৌড়ায়। গোধূলীতে একসাথে সবাই যখন ছন নিয়ে ফিরেন তখন দারুন এক ছন্দ ও শনশন গুঞ্জন উঠে। এরা কত ভেতরে যায় দেখার ইচ্ছে ছিলো আমার। তাছাড়া জসিম হুজুরের কাছে শুনলাম এদিকে পাহাড় পাড়ি দিয়ে বায়েজিদ বোস্তামীর মাজারেও যাওয়া যায়। যদিও এই পথে "শয়তান জ্বিন" এর উৎপাত আছে বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বার্ষিক পরীক্ষা ফুরোনো ডিসেম্বরের কোন এক সকালে আমি আর রিপন শন ওয়ালাদের ট্রেইলে ঢুকলাম। জনমানবশূণ্য নীরব পাহাড়। শুধু পাখিদের কলকাকলী, ছায়াময় কিছু জায়গায় দিনে দুপুরে ঝিঝি ডাকছিলো। এভাবে অনেকটা ভেতরে যাবার পর কুলগাছ পেয়ে কুল পেরে খেলাম। রোদ তাতিয়ে উঠছে, পাহাড়ী ছড়া পেয়ে পানি খেলাম, হাতেমুখে পানি দিলাম। একজায়গায় গিয়ে একটা জনশূণ্য তালাবদ্ধ কুড়েঘর পেলাম। সাইনবোর্ডে লেখা জঙ্গল সলিমপুর। (এই জনশূন্য জায়গাটিই এখন অপরাধপ্রবণ বাস্তুহারা সন্দ্বীপ কলোনী।) এক জায়গায় গিয়ে দেখি ট্রেইল তিন দিকে আলাদা হয়ে গেছে। আমরা হাতের ডানে চললাম। আরেকটা কুড়েঘর পেলাম। কুড়েঘরের সামনে ছোট্ট একটা জলাশয়। বড় এক জামগাছের ছায়ায় জলাশয়ের বাঁধানো ঘাট ও আছে। কুড়েঘরে উঁকি দিয়ে দেখি নামাজের বিছানা পাতা। দানবাক্সে লেখা জামতলা মাজার। পাশেই উঁচু এক পাহাড়ে লাল নিশানা উড়ছে। আমরা আসলে কোনদিকে আছি বুঝার জন্য পাহাড়ে চড়লাম। সাগর দেখে পশ্চিম শনাক্ত করলাম কারণ আমাদের যেতে হবে পুবদিকে। এরই মধ্যে থেমে থেমে গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো, ভয় পাচ্ছিলাম। (আসলে কাছেই ক্যান্টনমেন্ট, ওদের নিয়মিত ফায়ারিং রেঞ্জের গুলির শব্দ) তাও পাহাড় থেকে নেমে পুবদিকের ধুর (পায়ে হাটা পথ) ধরলাম। এরই মধ্যে ঝাঁকা মাথায় কিছু মহিলার সাথে দেখা হলো। তারা ফৌজদারহাট যাচ্ছিলো। আমাদের জানালো আমরা প্রায় চলে এসেছি। আরো আধাঘন্টা  হাটার পর আমরা একটা ইট বিছানো রাস্তা পেলাম। ঐ রাস্তা ধরেই বায়েজিদ শিল্পাঞ্চলের পাকা রাস্তা পেয়ে ন্যাশনাল টি বোর্ডের পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসলাম। এরপর বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার। আমার কাছে ছিলো সাকুল্যে দশ টাকা। রিপনের কাছে কোন টাকা ছিলোনা। তাই কাছিমকে কাঠিতে গেথে পাউরুটি খাওয়ানো হলোনা। মাজারের পাহাড়ে উঠার সময় আমরা জুতা বাক্সে জমা না দিয়ে হাতে নিয়ে উঠতে চাইলে মাজারের খাদেম আমাদের বাঁধা দিলেন। উনি জুতা নিয়ে বাক্সে রাখলেন। মাজার ঘুরে ফেরার সময় জুতা ফেরত নিতে গেলে চার টাকা রেখে দিলেন। আমাদের দশ টাকার পুঁজি নেমে গেলো ছয় টাকায়। একজনের কাছ থেকে সময় জানলাম, তিনটা বেজে গেছে। এইবার আতংক পেয়ে বসলো। কারণ বাসায় গেলে কনফার্ম মার খাওয়া লাগবে। (আমি একা আসলে সমস্যা ছিলোনা। আমার মা এতো কড়া ছিলেন না। কিন্তু রিপনের আম্মা এতোক্ষণে নিশ্চয় বিচার দিয়ে দিয়েছেন আমার বাসায়।) ছয় টাকায় ভদ্রভাবে ফেরা সম্ভব না, কিন্তু যেপথে এসেছি সে পথে ফেরার সাহসও হলোনা। তাই হাটা শুরু করলাম। হাটতে হাটতে দুই নাম্বার গেট আসলাম। তখনো চিটাগাং শহরে সিটি সার্ভিস বাস চালু হয় নাই। ম্যাক্সি চালু হয়েছে সদ্য, মূল গণপরিবহন হচ্ছে হলুদ টেম্পু। জিইসির মোড় থেকে কর্ণেলহাটের ভাড়া চার টাকা। ঐ হিসাবে দুইজনের ভাড়া আট টাকা। আমাদের আছে মোটে ছয় টাকা। তাই দুই নাম্বার গেট থেকে জিইসি না গিয়ে রেললাইন ধরে হাটা ধরলাম। কারণ জানি ঝাউতলা থেকে কর্ণেলহাটের ভাড়া তিন টাকা। একদিকে বাসায় ফেরার তাড়া, আরেকদিকে পেটে খিদে। রেললাইন আর ফুরোচ্ছিল না। অবশেষে ঝাউতলা পৌছুতে পারলাম। বাসায় ও পৌঁছুলাম। রিপনের আম্মু আমাদের বাসায়ই বসে ছিলেন। আমি ধরা। কিন্তু কেন যেন আম্মা কিছুই বললো না। এভাবেই শেষ হলো আমারমার জীবনের প্রথম এক্সপেডিশন সার্কিট! যে নির্জন ঘন ঝোপ-জঙ্গল আর বনে ঠাসা পাহাড়গুলোর কথা বললাম সেগুলো ছিলো বানর, সজারু, হরিণ, বনরুই, সাপ আর নানারকম পাখিতে ঠাসা এক নিবিড় অরণ্যভূমি। এখন তার দশ ভাগও অবশিষ্ট নেই। পাহাড় দখল করে গড়ে উঠেছে সন্ত্রাসকবলিত বাস্তুহারা জনপদ, এশিয়ান উইম্যান ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাস, পাহাড় চিরে হচ্ছে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ সংযোগ সড়ক। যত যাই হোক,  এখনো আমি চোখ বন্ধ করলেই অনুভব করতে পারি সেই নির্জনতা। সবুজের মাঝে ছায়াময় পায়ে চলা পথে ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনি!

1 comment:

  1. খুবই সুন্দর স্মৃতিচারণা।
    লেখায় একটু স্পেস থাকলে পড়তে ও দেখতে আরও ভালো লাগবে।

    ReplyDelete