24 May 2020

নজরুলের প্রেম, নজরুলের প্রেমিকা

 মাত্র চল্লিশ বছরের জীবন। বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারাবার আগে শৈশব বাদ দিলে নজরুলের কৈশোর আর যৌবনের পরমায়ু ২৬-২৭ বছর বড়জোর। এই অল্প সময়ের মধ্যেই প্রেমে উন্মাদ নজরুলের বিয়ে দুইটি, প্রকাশিত বা চাউর হওয়া প্রেমের সংখ্যা কমপক্ষে এক ডজন। অপ্রকাশিত প্রেমের সংখ্যা না জানি কত!

নজরুলকে জানতে হলে তাই নজরুলের প্রেমিকাদের চিনতে হবে৷ এবং নজরুলের প্রেমিকাদের নিয়ে এই লেখা পড়ার আগে মাথায় রাখতে হবে আমি কোন নজরুল গবেষক নই। পড়েছি অল্প তাই নজরুলকে নিয়ে আমার জ্ঞানও ভাসা ভাসা৷ লেখার কলেবর বেড়ে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটুক চাইনা বলেই অনেক কিছুই সংক্ষেপে ঝেড়ে দিয়েছি। আমার এই লেখা তাই যারা নজরুল বিশেষজ্ঞ নয় শুধু তাদের জন্যই!

১/ নজরুল ওরফে নুরু দশ বছর বয়স থেকেই লেটোর দলে গান গাইতেন। সেই সময়ে তার ভালো লাগে সমবয়সী এক কিশোরীকে(!) মেয়েটি তার দূরসম্পর্কের আত্মীয়ও বটে৷ যেহেতু মেয়েটির বাড়ি তাদের গ্রাম চুরুলিয়াতেই সুতরাং নিয়মিত দেখাসাক্ষাত হতো। দুটি হৃদয় কাছাকাছি এসেছিলো। কিন্তু  যেহেতু মেয়েটি ছিল ধনী পরিবারের তাই তখন পরিণতি পায়নি৷ নুরুকেও তখন জীবিকার সন্ধানে ঘর ছাড়তে হয়েছিল। শোনা যায়, করাচির সেনাপল্টন থেকে ফিরে বিশ বছরের নজরুল একবারই গিয়েছিলেন চুরুলিয়ায়। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গিয়েছে শুনে ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। নজরুল আর চুরুলিয়ায় ফিরেননি!


২/ ১৯১৫ সালে ১৫ বছর বয়সে নজরুল আবার ভর্তি হলেন রানীগঞ্জ শিয়ালসোল হাই স্কুলে। গরিব অথচ মেধাবী ছাত্র হিসেবে মাসে সাত টাকা বৃত্তি যোগাড় করলেন স্থানীয় রাজবাড়ি থেকে। নানা কায়দা করে আশ্রয় জুটিয়ে নিলেন মোহামেডান বোর্ডিংয়ে। সেসময় স্কুলে যাতায়াতের পথে তার নজর পড়ে এক পঞ্চদশীর প্রতি। নাম তার স্বর্ণলতা। সুন্দরী মেয়েটির বাবা রানিগঞ্জে পুলিশ অফিসার। নজরুল একে মুসলিম, তার উপর গরীব। গোপন প্রেম তাই এবারও সফল হলোনা। ফলাফল মিউচুয়াল ব্রেক আপ। শেষ দেখার দিন ভালবাসার স্মারক হিসেবে নজরুল স্বর্ণলতার চুল থেকে জোর করে খুলে নিলেন তার মাথার কাঁটা। সেই কাঁটাকেই নজরুল স্মরণ করেছেন তাঁর ‘‌ব্যথার দান’‌ গল্পগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে!

 ‘‌মানসী আমার!‌ চুলের কাঁটা নিয়েছিলুম বলে ক্ষমা করোনি, তাই বুকের কাঁটা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলুম।’

৩/ উল্লেখ্য নজরুল বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গেলেও যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার কারণে পাকিস্তানের করাচী পার হতে পারেননি ও কোনদিন অস্ত্র হাতে নেয়ার সুযোগও পাননি। (উল্লেখ করার লোভ সামলানো যাচ্ছেনা যে বাঙালি পল্টনে তাঁর বস ছিলেন টাঙ্গাইলের বিশিষ্ট দানবীর ধনকুবের রনদা প্রসাদ সাহা।) যুদ্ধে নজরুল প্রমোশন পেয়ে সৈনিক থেকে হাবিলদার হয়েছিলেন এবং যুদ্ধ পরবর্তী কয়েক বছর তা নিয়ে খুব গর্বিত ছিলেন। চিঠিসহ সর্বত্র নিজের পরিচয় লিখতেন হাবিলদার নজরুল এসলাম (নূরা)! যুদ্ধশেষে ৪৯ নং বাঙালি রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হল। নজরুল ফিরে এলেন কলকাতায়। বেকার নজরুল তখন কলকাতার গরমে আর্মি ইউনিফর্ম পড়ে ঘুরেন আর আমি হাবিলদার নজরুল এসলাম বলে ফাপর নিয়ে বেড়ান। তবে তাতে তো আর ক্ষুধা মিটেনা তাই একদিন চাকুরীর জন্য দেখা করলেন শেরে বাংলা এ কে‌ ফজলুল হকের সঙ্গে। উনার দরবারে কেউ নিরাশ হয়না। নজরুলও পেলেন প্রকাশিতব্য নবযুগ পত্রিকার সহ–‌সম্পাদকের দায়িত্ব। পত্রিকার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে খেটে নজরুলের শরীর ভেঙে পড়ল। তাই ডাক্তারের পরামর্শে হাওয়াবদলের জন্য গেলেন দেওঘর। সেখানে তাঁর সঙ্গে একটি মেয়ের পরিচয় হল। ক্রমশ ঘনীভূত হল নৈকট্য, যার ব্যাপারে পরবর্তীতে ডিটেইলস জানা যায়নি৷

৪/ ১৯২১ সালের মার্চে নজরুল তাঁর প্রকাশক আলী আকবরের সাথে কুমিল্লা বেড়াতে যান৷ নজরুলকে নিয়ে আলী আকবর খান তার স্কুলের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় উঠেন। বীরেন্দ্রকুমারের মা ছিলেন বিরজা সুন্দরী দেবী। নজরুল তাঁকে মা বানান। কয়েকদিন পর প্রকাশক আলী আকবর কবিকে তার গ্রামের বাড়ি দৌলতপুর নিয়ে যান। সেখানে নজরুলের আকবরের বিধবা বোনের মেয়ে সৈয়দা আসার খানামের সাথে প্রেম হয়। নজরুল তাঁর নাম দেন নার্গিস৷ নার্গিসের সাথে কিছুদিনের অভিসার শেষে নজরুলের আকদ হয়। কিন্তু আকদের রাতেই মামাশ্বশুর আকবরের দেয়া ঘরজামাই থাকার শর্তে/অজানা কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে নজরুল কুমিল্লায় ফিরে আসেন। নজরুল আর কখনো দৌলতপুর ফিরেননি। পরের ১৬ বছর তাঁদের আর দেখাও হয়নি। তবু নার্গিস অপেক্ষা করেন। তাঁর সে অপেক্ষা আর ফুরোয়নি! ১৯৩৭-৩৮ সালের দিকে তাঁদের আনুষ্ঠানিক ডিভোর্স হয়।

৫/ আলী আকবরের সাথে কুমিল্লায় গিয়ে প্রথম যে বাড়িতে নজরুল উঠেছিলেন, সেই বাড়ির কর্ত্রী বিরজা সুন্দরী দেবী কবিকে পূত্রবৎ স্নেহ করতেন, কবিও তাঁকে মা বলে ডাকতেন । সেই যৌথ পরিবারের সদস্য বিরজা সুন্দরী দেবীর বিধবা জা গিরিবালার কন্যা ১১ বছরের আশালতার (যার ডাকনাম ছিলো দোলনচাঁপা বা দুলি) সাথে কবির প্রেম হয়। সেসময় ভিন্ন ধর্মের এই প্রেমের কারণে কুমিল্লা শহরের যুবকদের হাতে কপবি ভালোই নাজেহাল হন। তিন বছর পর ১৯২৪ সালে কবি এই আশালতাকেই বিয়ে করেন এবং তার নাম দেন প্রমীলা। বিয়েটা হয়েছিল স্ব-স্ব ধর্মপরিচয় বহাল রেখেই এবং প্রমিলা কখনোই ধর্ম পরিবর্তন করেননি। বরং প্রমিলা প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে গেলে নজরুলই বরং প্রমিলার আরোগ্য কামনায় এক সৃষ্টায় বিশ্বাস হারিয়ে কালিপূজায় মত্ত হয়ে পড়েছিলেন। বিয়ের সময় প্রমিলাদেবীর বয়স ছিল মাত্র ১৪। সেই কিশোরী প্রমীলা দেবী আমৃত্যু সকল সুখ-দু:খের বোঝা মাথায় নিয়ে কবির জীবন সঙ্গিনী ছিলেন।



৬/নজরুল ঢাকায় আসলে উঠতেন তাঁর বন্ধু প্রফেসর কাজী মোতাহার হোসেনের বাসায়। (সেবা প্রকাশনীর কাজী আনোয়ার হোসেনের বাবা) ঢাকাতেই তার বন্ধু মতিহারের মাধ্যমে পরিচয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকোত্তর মুসলমান ছাত্রী মিস ফজিলাতুন্নেসার। নজরুল বিশেষ করে নারীদের হাত দেখতে পছন্দ করতেন, সেভাবেই প্রথমে হাত দেখে ভাগ্য গণনার ছলে ফ্লার্ট করতে চাইলেও পরে কবি মিস ফজিলাতুন্নেছার গুণে মুগ্ধ হয়ে তাঁর প্রেমে উন্মাদ হয়ে পড়েন! কিন্তু নজরুল ফজিলতুন্নেসার হৃদয় জয় করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হন। ঢাকা থেকে ফেরার পথে প্যাডেল স্টিমারে বসে কবি ফজিলাকে প্রথম প্রেমপত্র লিখেন। মোতিহার সে চিঠি ফজিলাকে পৌঁছে দিলে সে অনুরোধ করেন তাঁকে যাতে আর ডিস্টার্ব করা না হয়। নজরুল তারপরও আরো ৭টি প্রেমপত্র লিখেন। শেষ পর্যন্ত নজরুলের একটি চিঠির উত্তর দেন ফজিলতুন্নেসা। এই চিঠিতে ফজিলতুন্নেসা নজরুলকে আর চিঠি না লিখবার অনুরোধ করেন। উত্তরে অভিমানী নজরুল ক্ষেপে গিয়ে  কাজী মোতাহার হোসেনকে জানান, তিনি আর কোনদিন ফজিলাকে চিঠি লিখবেন না। বলাই বাহুল্য তিনি তার কথা রাখতে পারেননি!

৭/ নজরুলের এই অপ্রকাশিত প্রেমটির পটভূমিও ঢাকা৷ ঢাকা কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপালের মেয়ে উমা মৈত্র ওরফে নোটনকে গান শিখাতে গিয়ে নজরুল নোটনের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন।  উমা মৈত্রের স্মৃতি কবি তার ‘শিউলিমালা’ গল্পটিতে ধরে রেখেছেন বলেই বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে গল্প থেকেই সরাসরি তুলে দেয়া ভালো। তবে মনে রাখতে হবে গল্প গল্পই!

“শিউলি আমার কাছে গান শিখতে লাগল। কিছুদিন পরেই আমার তান ও গানের পুঁজি প্রায় শেষ হ্যে গেল। মনে হল আমার গান শেখা সার্থক হয়ে গেল। আমার কন্ঠের সকল সঞ্চয় রিক্ত করে তার কন্ঠে ঢেলে দিলাম। আমাদের মালা-বিনিময় হল না-হবেও না এ জীবনে কোন দিন- কিন্তু কন্ঠ বদল হয়ে গেল। আর মনের কথা সে শুধু মনই জানে।… একমাস ওদের বাড়িতে ছিলাম। কত স্নেহ, কত যত্ম, কত আদর। অবাধ মেলা মেশা- সেখানে কোন নিষেধ, কোনো গ্লানি, কোন বাধা বিঘ্ন, কোন সন্দেহ ছিল না। আর এসব ছিল না বলেই বুঝি এতদিন ধরে এত কাছে থেকেও কারুর করে কর স্পর্শ-টুকুও লাগে নি কোনদিন। এই মুক্তিই ছিল আমাদের সবচেয়ে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা। কেউ কারো মন যাচাই করিনি। কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসার কথাও উদয় হয় নি মনে। একজন অসীম আকাশ, একজন অতল সাগর। কোন কথা নেই-প্রশ্ন নেই, শুধু এ ওর চোখে, ও এর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে”।

৮/ নজরুলের পরবর্তী স্ক্যান্ডাল ঢাকার টিকাটুলির মেয়ে রানু সোমের সাথে। অত্যুৎসাহী নজরুল ঢাকায় এসে কিছুদিন রানু সোমকে গান শেখাতেন। মুসলমান যুবক কবি প্রতিদিন হিন্দু যুবতীকে গান শেখানোর আড়ালে তার বাসায় গিয়ে ঘনিষ্ট হচ্ছেন এমন গুজব রটিয়ে পড়ে। একরাতে রানু সোমের বনগ্রাম রোডের বাসা থেকে ফেরার পথে ৭/৮ জন হিন্দু যুবকের দল নজরুলকে আক্রমণ করে। নজরুল প্রতিরোধ গড়ে তুলেন ও পরে টহল পুলিশ আসলে আক্রমনকারী যুবকরা পালিয়ে যায়। রানু সোমের সাথে পরবর্তীতে কবি বুদ্ধদেব বসুর বিবাহ হয় ও তিনি প্রতিভা বসু নামে পরিচিতি লাভ করেন।

৯/ অবশেষে কবি পূর্ব বঙ্গ থেকে বের হতে পারলেন। তাঁর পরবর্তী সম্ভাব্য প্রেমিকা মীরা বা জাহানারার সাথে তার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ১৯৩১ সালে দার্জিলিংয়ে ঘুরতে গিয়ে। সেই সফরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মৈত্রেয়ী দেবীসহ আরো বিখ্যাত লোকজন ছিলেন। কলকাতায় গিরে মীরার সাথে কবির সম্পর্ক আরো গাঢ হয় বলে জনশ্রুতি থাকলেও সে সময় কিছু প্রমাণ হয়নি। তবে নজরুলের মৃত্যুর পর মীরা ম্যাম চমক জাগান তাঁকে উদ্দেশ্য করে লেখা ৮টি কবিতা ও ৭টি অপ্রকাশিত গানের একটি খাতা প্রকাশ করে। যার ফলে বহুবছর পর নজরুল মীরার বিশেষ সম্পর্ক সম্পর্কে বাজারে থাকা ধারণা বেশ পোক্ত হয়!

১০/ নজরুলের সবচে সেলিব্রেটি প্রেমিকা ছিলেন সে সময়ের বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী কাননদেবী৷ কানন দেবীকেও কবি নজরুল গান শিখিয়েছিলেন। সেসময় কানন ও নজরুলকে জড়িয়ে নানান মুখরোচক স্ক্যান্ডাল বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। তখন সবাই বলাবলি করতেন কবিকে কলকাতার আর কোথাও পাওয়া না গেলে যেতে হবে কানন দেবীর বাড়িতে! সেখানে তাঁকে অবশ্যই পাওয়া যাবে। যেতোও!

মনে রাখতে হবে সেসময় টিন্ডার ছিলোনা, ফেসবুক ছিলোনা, ছিলো না মোবাইল ফোন। এত সুযোগের পরেও আমাদের জীবনে আজ প্রেমের বড্ড অভাব! অথচ নজরুলের জীবনে প্রেম/বিরহ বা প্রেমিকার অভাব হয়নি একটা দিনের জন্যও! কবির প্রতিভার ঝলক, তাঁর চকিত চাহনী আর চিঠিই ছিলো ভরসা। সেই সামান্য যোগাযোগের সুযোগ, অমিত সাহস আর কাব্য ও সঙ্গীত প্রতিভাকে পুঁজি করে প্রেমিক নজরুল সে যুগেই সকল সীমাবদ্ধতাকে জয় করে কাঁপিয়ে দিয়ে গেছেন।

নজরুলের জীবনের প্রেমিক অধ্যায় হতে পারে এ যুগের যুবকদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত৷ কোন নারীকে অসন্মান না করে, ধর্ষকামী না হয়েও প্রেম প্রকাশে দুর্বিনীত ও বাঙময় হওয়ার শিক্ষা নজরুল জীবনে উপস্থিত৷

আজও সবসময় জিতে যাওয়া মানুষদের উপদেশ থাকে listen to your ♥ heart! হৃদয়ের আর্তি শুনে চিরকাল তা মূল্যায়ন করে যাবার সাহস সবার থাকেনা৷ যাদের থাকে তাঁরাই নজরুল। হৃদয়চালিত ছিলেন বলেই নজরুল শুধু নারী নয়, সেইসাথে ভালবেসেছিলেন দেশকে, দেশের মানুষকে, মানবতা আর সত্য-সুন্দরকে। আজ নজরুলের জন্মদিন। যুগ যুগ জিও!



No comments:

Post a Comment