28 Jun 2020

Departed Melody : কর্ণফুলী ডুবানো কাপ্তাই লেক ও দেশছাড়া রাজা ত্রিদিব রায়



বৃটিশ আমলে যখন প্রথম কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে হাইড্রোপাওয়ার প্ল্যান্ট বসানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিলো তখন ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবেনি ভবিষ্যতে কর্ণফুলীর কাপ্তাই চিৎমরম সংলগ্ন অংশে ড্যাম হবে। রাঙামাটি শহর, রাজবাড়ি ও মাইনী ভ্যালির মাইলের পর মাইল সমতল চাষযোগ্য জমি নিরাপদে রেখে তখনকার ভাবনায় এ প্রজেক্টের সম্ভাব্য লোকেশন ছিলো বরকলে, আপার কর্ণফুলী তে। (সেখানে বিশাল একটা জলপ্রপাতও ছিলো কর্ণফুলী নদীতে। যা এখন পানির নিচে হারিয়ে গেছে।) তারপর দেশভাগ হলো। নতুন মানচিত্রে কর্ণফুলীর সোর্স পড়লো ভারতে। এখন যদি বরকলে ড্যাম দেয়া হয় তাতে রাঙামাটি শহর, রাজবাড়ি বাঁচলেও এর ফলে চান্স ছিলো ভারতের মিজোরামের কিছু অংশ প্লাবিত হবার। যা ভারত কোনভাবেই মেনে নিতো না। ৪৭ এর পরপরই সদ্য কাশ্মীর যুদ্ধ শেষ করা পাকিস্তান এই ঝুঁকি নিয়ে আরেক যুদ্ধ লাগালোর সাহস করলোনা। তাই বাঁধ চলে এলো ডাউনস্ট্রীমের কাপ্তাইয়ে। রাতারাতি ডুবে গেলো রাঙামাটি শহর সহ শত শত বর্গকিলোমিটার নিচু জমি। চাকমা রাজবাড়িও চিরতরে চলে গেলো জলের নিচে। একরাতে ঘটা এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে প্রজেক্টের সব শ্রমিক ভয়ে পালিয়ে গেলো। দূর্গম দূর-দূরান্তে বসবাসকারীরা ঘুম ভেঙ্গে বিনা নোটিশে বাস্তুহারা হলো। কিছু পাহাড়ের মাথা ব্যাতীত কর্ণফুলী ভ্যালির সবকিছুর সলিল সমাধি হলো লেকে জমা জলের তলে। জমি জিরাত সব হারিয়ে উদ্বাস্তু হলো মূলত চাকমারা। ক্ষতিপূরণের নামে তাদের সাথে তামাসা চললো কিছুদিন৷ যদিও শুধু এডিবিই ক্ষতিপূরণ বাবদ সে সময় ২০ কোটি দিয়েছিলো যা এখনকার ২০০-৩০০ কোটির সমান) এরপর পাকিস্তান ছেড়ে ভারত চলে যাওয়া চাকমাদের একাংশকে অরুণাচলে আশ্রয় দিলো ভারত সরকার। তারা এখনো সেখানে আছেন। জাতির এই দূর্দিনে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় নীরব রইলেন।


এই প্রতিক্রিয়া না দেখানো প্রতিক্রিয়াশীলতা অব্যাহত রইলো ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধেও। তিনি পাকিস্তানের পক্ষে সর্বাত্মক ভাবে কাজ করলেন। নিজ জাতিকে পিছিয়ে দিলেন আরো ৫০ বছর। তবু আমি তাকে ইমানদারই বলবো কারণ ৭১ এর নভেম্বরে দেশ ছাড়ার পর যে দেশ তিনি চাননি সে দেশে ইচ্ছা থাকা সত্বেও আর একটিবারের জন্যও তিনি ফিরে আসেননি। পরবর্তীতে পাকিস্তানের সংখ্যালঘু/পর্যটন মন্ত্রী হয়েছিলেন। জীবনভর পাকিস্তানে অন্যরকম সন্মান পেয়েছেন। ছিলেন শ্রীলঙ্কা ও  ল্যাটিন আমেরিকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত। তাঁকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হবার অফার দেয়া হয়েছিলো কিন্তু যেহেতু সংবিধান অনুসারে কোন অমুসলিম পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না তাই তাকে বলা হয়েছিলো বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হলে তিনি হবেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। তিনি সে অফার ফিরিয়ে দেন। অর্ধযুগ আগে পাকিস্তানেই মৃত্যু হয় ত্রিদিব রায়ের। তার শেষ ইচ্ছানুযায়ী লাশ দেশে আনতে চেয়েছিলো তার পরিবার। কিন্তু দেশের তরুণ প্রজন্মের একাংশের প্রতিবাদের মুখে তা আর সম্ভব হয়নি। মৃত্যুর প্রায় দশদিন পর ইসলামাবাদেই তার অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।



ছবিতে দেখা যাচ্ছে দূরের ২২০০ ফুট উঁচু SS পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা মেঘ। আর তার নিচে বয়ে যাওয়া কর্ণফুলী। বরকলের এখানেই কোথাও হবার কথা ছিলো ড্যাম। তাতে একটি জাতির ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো! হয়তো আজকের কাপ্তাই লেকের নাম হতো বরকল লেক। হয়তো হতোনা চাকমাদের সাথে বাঙালির জাতিগত বিরোধ। যা অনেকাংশেই যতোটা রাজনৈতিক তারচে বেশি অর্থনৈতিক।

আজ একবিংশ শতাব্দীর দুই দশক পর এই  লেক ও জলবিদ্যুত কেন্দ্র দেশের চাহিদার এক পার্সেন্ট ও যোগান দিতে পারছেনা। তারপরেও ইতিমধ্যে যেহেতু কেটে গেছে ৬০ বছর তাই কাপ্তাই লেকে গড়ে উঠেছে নিজস্ব বাস্তুসংস্থান। যা এখন সম্পদ হয়ে উঠেছে ও গড়ে দিয়েছে নতুন সব সম্ভাবনা। স্পেশালি ট্যুরিজম। কিন্তু পাকিস্তান আমলে এজ এ ডেষ্টিনেশন কাপ্তাই লেককে তারা যেভাবে প্রমোট করতে পেরেছিলো স্বাধীন দেশে আমরা তা পারিনি। তখন কাপ্তাই লেকে বিদেশীরা আসতো ওয়াটার স্কি, কায়াকিং করতে। ছিলো হাউস বোট। আর এখন সেখানে বিদেশী ট্যুরিষ্ট নিতে চাইলে নিতে হয় স্পেশাল পারমিশন। পাঁচ-ছয় বছর আগেও পদ্ধতিটা আরেকটু সহজ ছিলো৷ চিটাগাং ডিসি অফিসের পার্মিশন ফরম পূরণ করে জমা দিলেই হতো। এখন ঘুরতে হয় কয়েকটা মিনিষ্ট্রি আর এজেন্সি। এত ঝামেলা কে করবে? উৎসাহ হারাচ্ছে ইনবাউন্ড ট্যুরিজম। ইন্টারনাল ট্যুরিষ্ট দেশের মূল্যবান ডলার খরচ করতে যাচ্ছে ভারত, থাইল্যান্ড, বালি, নেপাল, মালয়েশিয়ায়৷ আসলেই এদেশে যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। দিনকে দিন আরো কঠিন হচ্ছে বাংলাদেশে পর্যটন পরিচালনা। হবেই না বা কেন, উল্টোপথে না হাটলে যে এ জাতির ভালো লাগেনা!


No comments:

Post a Comment