18 Oct 2020

রকষ্টারের বিদায়ের দুই বছর


 বাচ্চু ভাইয়ের সেকেন্ড সলো এলবামের কাভারে লিখা ছিলোঃ 


"তারপর একদিন ভরা জোৎস্নায় আমিও চলে যাব 

একমাত্র নিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে- চির নবান্নের দেশে,

জেনে যাবো; সবকিছুই বড় দেরিতে আসে,

বড় দেরীতে ধরা দেয়; হারিয়ে যায় সেও হঠাৎ করেই! 

শুধু কষ্টটা থেকে যায়! 

আসলে কষ্টটা

এভাবেই ছিল-

কষ্টটা এভাবেই থাকে....!!!"


গায়কী প্রতিভার কথা ভাবলে ছিলেন মিডিওকারেরও নিচে, বিলো এভারেজ। ঘষে-মেজে, সাধনায়, গিটার বাদনে নিজেকে নিয়ে গেছেন লিজেন্ড লেভেলে। সেই স্কুলে পড়ার সময়ই বাবা-মায়ের সেপারেশন। সত্তরের দশকের কথা আমলে নিলে আসলে সেপারেশন ওয়ার্ডটা দিয়ে বিষয়টার ভয়াবহতা বুঝানো যাবেনা। সিম্পলি তখন মানুষ বউ ছেড়ে দিতো যেভাবে তেমনই ছিলো ব্যাপারটা। তিন ভাই নিয়ে এনায়েতবাজারের বাবার বাড়ি থেকে মা সহ বাচ্চুরা চলে আসলেন মাদারবাড়ির নানাবাড়িতে৷ বাবার স্নেহহীন শৈশব-কৈশোরের কষ্টের দিনগুলো বাচ্চু ভাই ভুলেননি কোনদিন, শেষদিকে গাওয়া তাঁর গান "বাবা" শুনলেই তাঁর বাবাহীনতার অভিমানসৃষ্ট কষ্টের তীব্রতা যে তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত  বয়ে বেড়িয়েছেন তা স্পষ্ট বুঝা যায়। তবু বাচ্চু ভাই বাবার সাথে যোগাযোগ রেখেছেন। নিজের কাছে এনে চিকিৎসা করিয়েছেন। সৎ বোন-বোনজামাইদের প্রতি বড়ভাইসূলভ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মা চলে গেলেও তাঁর বাবা এখনো বেঁচে আছেন দুনিয়ায়, বাচ্চু ভাই নেই!  


মুসলিম স্কুল পেরিয়ে সিটি কলেজে, বাচ্চু ভাইয়ের পড়াশোনা আর সামনে গেলোনা গিটারের নেশায়৷ রেয়াজুদ্দিন বাজারে মামার জুতোর দোকানে বসতে হয়, সারাদিন এর পায়ে-ওর পায়ে জুতো গলিয়ে সন্ধ্যায় লালখানবাজারে গিয়ে গুরু জ্যাকব ডায়াসের কাছে থাকা ইলেকট্রিক গিটারটা ছুঁয়ে দেখা৷  যতোটা পারা যায় প্র‍্যাক্টিস করে নেয়া। নিজের যে গিটার নেই!  যখন যে ব্যান্ডে বাচ্চু বাজায় বাকি সবাই বিরক্ত। ছেলেটা সারাদিন প্র‍্যাক্টিস করতে চায়৷ সব গানে পার্টিসিপেট করতে চায়। কিন্তু সোলসের মত মেলো টাইপ ব্যান্ডে লিড গিটারিষ্টের সবসময় পার্টিসিপেশনের সুযোগটা কই? তাই যখন 'মন শুধু মন ছুঁয়েছে' রেকর্ড হয় তখন নিজের অংশগ্রহণ না থাকায় হাত নিশপিশ করতে থাকা বাচ্চু পুরো গানে দুইটা কাঠের টুকরো বাজিয়ে গেলো যা মূল গানের ব্যাকগ্রাইন্ডে এখনো শুনতে পারবেন পুরোটা সময়। এসবই হলো প্রতিভার স্ফুরণ! 


বাচ্চু ভাই নিজে কিছু গাইতে চান, সোলসে রথী-মহারথীদের ভীড়ে চান্স হয়না৷ কি করা যায়? সলো করা যাক! চট্টগ্রাম হকার মার্কেটে জাহেদ ইলেকট্রনিক্সের মূল ব্যবসা শেফালী ঘোষ-শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের আঞ্চলিক গান, মাইজভান্ডারী, মোহসিন আউলিয়া, ওরসের গান বেচা। মরিয়া বাচ্চু তাদের দূর্বল রেকর্ডিংয়েই দুটো এলবাম করে ফেললেন। কোন লাভ হলোনা। আসতে পারলেন না পাদপ্রদীপের আলোয়। অন্যদিকে সোলসের সাউন্ডে যে ডিসটর্শন চান তা পান না। বুঝলেন ঢাকামুখী হতে হবে৷ আলাউদ্দিন আলীদের সাথে কিছু সিনেমার কাজ করে সঙ্গীত পরিচালনা আর সুরের ব্যাপারে অনেক দৃষ্টি প্রসারিত হলো৷ এভাবেই তপন চৌধুরী থেকে জুয়েল অনেকের ডেব্যু হিট এলবামের পিছনের কারিগর হলেন বাচ্চু ভাই৷ কিন্তু সুরকার-সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে ক্যাসেটের কাভারে ব্যবহার করতেন ছদ্মনামঃ রবিন। 


শেষ পর্যন্ত পাততারি গুটিয়ে এলেন ঢাকায়৷ ততোদিনে কিছুটা পরিচয় হয়েছে৷ সোলস ছেড়ে দিয়েছেন। বিয়েও করেছেন বরিশালের মেয়ে। দেশের প্রথম আবাসিক ব্যান্ড এলআরবি শুরু হলো৷ ফুলটাইম আবাসিক আর ফুলটাইম জ্যামিং করা ব্যান্ড। চৌধুরীপাড়ার দুই রুমের বাসার এক রুমে বাচ্চু ভাই থাকতো বউ সহ, আরেক রুমে তাঁরই ছাত্র স্বপন, জয় আর সিইউতে থাকতে ফিলিংসে বাজানো টুটুল। ( তখন জেমস-ফান্টি ব্যান্ড বাদ দিয়ে কানাডায় কামলা দিতে যাওয়ায় টুটুলের এলআরবিতে আসা) জয় বিদেশ গেলো দুই বছরের মাথায়, স্বপন থাকলো শেষদিনতক,  টুটুল তানিয়ার সাথে বিয়ের পর নিজের ক্যারিয়ার গুছাতে চলে যায়। শেষদিন পর্যন্ত বাচ্চু ভাই টুটুলের জায়গায় কাউকে নেননি৷ কিবোর্ড ছাড়াই বাজিয়ে গেছে এলআরবি৷ 


বাচ্চু ভাই চিটাগাং এর ছেলে৷ চিটাগাং এর ছেলেরা বাস্তববাদী,  দায়িত্বশীল আর সংসারী হয়। বাচ্চু ভাইও আজীবন তাই ছিলেন। ব্যবসা এখানে ধর্ম, অস্থিরতা বা পাগলামীর কোন স্থান নেই এখানকার সমাজে। তাই একজন রকষ্টারের অস্থিরতা বুকে ধারণ করে সংসারের সাথে আপস করার কঠিন দ্বন্দযুদ্ধ লড়তে লড়তেই বাচ্চু ভাইয়ের সংগ্রামী জীবন ফুরিয়ে গেছে। না হতে পেরেছেন মুক্ত বিহঙ্গ, না পেয়েছেন পাতানো সংসারে সুখ! বাচ্চু ভাইরা কখনো দায়িত্বের শিকল ছিড়ে মুক্ত আকাশে হারিয়ে যেতে পারেনা৷ মৃত্যুভিন্ন বাচ্চুদের মুক্তি নেই। বাচ্চু ভাই মুক্তি পেয়েছেন।


(আজ বাচ্চু ভাইয়ের মৃত্যুর দুই বছর পূর্তি। 

এই দিনটার জন্যও লোকটা একটা গান গেয়ে গেছেন। লিংকঃ

https://youtu.be/866zsqXqyXs

No comments:

Post a Comment