17 Nov 2020

বিরামপুরের গল্প

 

বিরামপুরের নাম শুনে কল্পনায় নীরব এক রেল স্টেশন, ভরদুপুরে ঘুমের ভারে ঢুলুঢুলু কিছু দোকানীসমেত অল্প কিছু টিনের দোকানপাট আর হলদে ফসলের প্রান্তর ছুঁয়ে যাওয়া শীতের ধুলো উড়া একটা পথ কল্পনা করে নিয়েছিলাম। তিন নাম্বার খানিকটা মিললেও বাকিগুলো মিললোনা। গত কয়েকবছর ধরে আর মিলে না।  নগরায়ণের গ্যাংগ্রিনে শহর তো পঁচে গেছে সেই কবেই! এখন গ্রামগুলোও আক্রান্ত হচ্ছে। বিভূতির উপন্যাস ছাড়া তাই কোথাও আর মিলেনা শতভাগ বিশুদ্ধ গ্রাম।


এখানেও বিষ লেগেছে। সন্ধ্যার পরও সব সরগরম। একশো টাকায় পাওয়া তিনশো টাকার এনার্জি লাইটের আলোয় চারপাশ রোশনাই। বাইছা লন একশো থেকে শুরু করে সান্ডার তেলের ক্যানভাসার সবাই উপস্থিত। সাময়িক দোকানীরা ঝাপ মেলে গ্র‍্যান্ডফাদার ক্লকের কোকিলটার মত উঁকি দিচ্ছে! শুধু কি তাই? ব্যাংকের বুথসমেত ব্রাঞ্চ বসে গেছে বেশ কয়েকটা!


আমি স্থানীয় একটা রেষ্টুরেন্টে ঢুকলাম। যেগুলোকে আমরা 'হোটেল' বলি! যতোটা না নিজে খেতে তারচে বেশি বৃদ্ধ রিকসাচালকটাকে কিছু খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে। নাহ তিনি চা ছাড়া কিছুই খাবেন না। জোরাজুরি করিয়ে শেষতক একটা মিষ্টি! দু-চারটা কথা হলো। বয়স ৬৫। জমি ছিলোনা কখনো তাই গত ৪৫ বছর ধরে রিকসাই চালিয়ে আসছেন। একমাত্র মেয়ের বিয়ে, একটা ভিটি আর ৪৫ হাজার টাকা দামের দুই বছর আগে কেনা এই মোটর রিকসাখানা সবই রিকশা চালিয়ে উপার্জিত টাকায়। আবারো মটর রিকসা জিনিসটাকে মহান এক আবিষ্কার মনে হলো আমার। বগুড়ার শেষ 'মেইল' চলে গেছে তারউপর বিরামপুরে পরিচিত কেউ নাই শুনে উদ্বিগ্ন হলেন। 'ম্যালা টাকা' দিয়ে পুরো ঢাকার টিকেট কেটে নাইটকোচে ঢাকা যেতে হবে বলে আফসোস করতে করতেই তার টিনের বাড়িতে চাইলে থাকতে পারি জানিয়ে দিলেন। আশ্বস্ত করলেন নতুন লেপ আছে। মেয়ের জামাই আসবে বলে নামান নাই এখনো। বেচারার কথা শুনে মায়া হলো। জানালাম চিন্তার কিছু নাই, আমাকে নিতে গাড়ি আসবে। দেড়শো টাকায় তিনঘন্টা চুক্তিতে 'কম হয়ে যায়' বললেও কিন্তু পাছে আমি অন্য রিকসা নিয়ে ফেলি সে ভয়ে দুপুরবেলা নিমরাজি হয়ে গিয়েছিলেন। তাই দুশো টাকা উনার হাতে দিয়ে রাখতে বললেও উনার দ্বিধা কাটেনা! জানতে চান "সবটা?"


এখানে মুসা ভাইয়ের অপেক্ষায় আমাকে ঘন্টাখানেক বসতে হবে তাই ওয়েটারকে বলে ফোনটা চার্জে দিলাম। ব্যস্ত 'হোটেল' তার উপর শহুরে কাষ্টোমার পেয়ে ওয়েটারদের ভালো ব্যবহারে কিছু না খেয়ে শুধু শুধু বসে থাকতে ইতস্তত লাগছিলো। তাই ঢাকায় আমরা যেটাকে মোগলাই বলি (ভেতরে কিমা থাকে) চিটাগাং এ যেটা ডিম-পরোটা (ভেতরে ডিম থাকে) সেই জিনিসখানা অর্ডার করলাম। সার্ভ হলো তেতুলের টক আর সালাদসমেত। কিন্তু ওমা ভেতরে যে আলুভাজি! এও কি হয়! এই অখাদ্য গেলা সম্ভব না। টাক মাথা ফর্সা ওয়েটার লোকটা বোধহয় বুঝলো ব্যাপারখানা। সে এসে আস্তে আস্তে বললো হাসের গোস্ত খাবেন স্যার? চালের রুটিও আছে। প্রথমে নিজের কান বিশ্বাস হলোনা। শেষমেষ ৬ টা রুটি চালান করলাম উদরে। গেটিস দেবার ছলে দুই প্লেট হাসভূনাই দিয়ে দিলো ওয়েটার। সত্যি বহুদিন এত ভালো খাবার খাই নাই। শেষে এক গেলাস দুধ নিয়ে আসলো নিজে থেকেই। জানালাম দুধ খাইনা। সে জানালো এটা ক্যাশ থেকে মালিকে পাঠিয়েছেন। কমপ্লিমেন্টারি! 


আচ্ছা এটা কি আসলেই ২০১৮?

No comments:

Post a Comment